আধুনিক জীবনের চাপ, প্রযুক্তির নেশা আর বস্তুবাদী চিন্তাভাবনার মধ্যে আমরা ক্রমশ আত্মিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছি। শরীরের যত্ন নেওয়ার পিছনে আমরা কত সময় ও শক্তি ব্যয় করি, কিন্তু আত্মার পরিচর্যা করতে গেলেই যেন অবহেলা করি। অথচ ইসলামে আত্মশুদ্ধিকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিছু ক্ষতিকর অভ্যাস, যা আমাদের আধ্যাত্মিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। আজ আমরা আলোচনা করব এমন তিনটি অভ্যাস সম্পর্কে, যা আত্মশুদ্ধির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।
১. অতিভোজন: শারীরিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষতির কারণ
বর্তমান সময়ে খাবারের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্য আমাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শেখায়। ইসলামে খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সংযম ও পরিমিতিবোধকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“মুমিন এক পেটে খায়, আর কাফির সাত পেটে খায়।” (বুখারি)
আধুনিক গবেষণাও প্রমাণ করে যে, অতিভোজন শুধু স্থূলতা ও ডায়াবেটিসেরই কারণ নয়, এটি মানসিক অস্থিরতা ও আধ্যাত্মিক দুর্বলতা ডেকে আনে। রোজা রাখা, হালাল খাবার গ্রহণ ও প্রয়োজন অনুযায়ী খাওয়ার মাধ্যমে আমরা এই অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
-
রোজা রাখুন: নফল রোজা (সোম-বৃহস্পতিবার, আইয়ামে বীজ) পালন করে খাদ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব।
-
ধীরে খান: রাসুল (সা.) ধীরে ধীরে খেতেন এবং খাওয়ার সময় থামতেন পেট পুরোপুরি ভরার আগেই।
-
অপ্রয়োজনীয় স্ন্যাকস এড়িয়ে চলুন: লোভনীয় খাবারের বিজ্ঞাপন থেকে দূরে থাকুন এবং ক্ষুধা না থাকলে খাবেন না।
২. অতিনিদ্রা: সময়ের অপচয় ও আধ্যাত্মিক অলসতা
ঘুম শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু অতিরিক্ত ঘুম আত্মার অলসতা ডেকে আনে। ইসলামে রাতের ইবাদতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“রাত্রিকালীন উঠা নফসকে দমনের জন্য অত্যন্ত কার্যকর এবং সে সময়ের জিকির-আজকার অধিক সুস্পষ্ট ও স্থায়ী।” (সূরা মুজাম্মিল: ৬)
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি বেশি ঘুমায়, তার অন্তর মৃতপ্রায় হয়ে যায়।” তাই তাকওয়া অর্জনের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত ঘুমের পাশাপাশি রাতের শেষাংশে তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
-
ভোররাতে উঠার চেষ্টা করুন: তাহাজ্জুদ বা ফজরের নামাজের জন্য জাগ্রত হওয়ার অভ্যাস করুন।
-
দিনে অল্প সময় ক্যাটন্যাপ নিন: রাসুল (সা.) দিনে কিছুক্ষণ ঘুমাতেন (কাইলুলাহ), যা শরীরকে চাঙা রাখে।
-
অলসতা ত্যাগ করুন: অকারণে বিছানায় সময় না কাটিয়ে ইবাদত বা প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যয় করুন।
৩. প্রবৃত্তির দাসত্ব: আত্মার পতনের মূল কারণ
মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ দুটো প্রবণতাই রয়েছে। যারা কেবল নিজের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তারা আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন,
“আর যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে উপাস্য বানিয়ে নেয়, তার চেয়ে গোমরাহ আর কে?” (সূরা জাসিয়াহ: ২৩)
বর্তমান যুগে লোভ, অহংকার, অশ্লীলতা ও মিথ্যার মতো প্রবৃত্তিগুলো খুব সহজেই আমাদের গ্রাস করে ফেলে। এগুলো থেকে বাঁচতে হলে প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত তাওবা-ইস্তিগফার।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
-
নিয়মিত জিকির ও দোয়া পড়ুন: “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলার অভ্যাস করুন।
-
সৎ সঙ্গী বাছাই করুন: খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করে আল্লাহওয়ালা মানুষের সান্নিধ্যে থাকুন।
-
প্রবৃত্তিকে চিনুন: যখন কোনো খারাপ ইচ্ছা মাথা চাড়া দেয়, তখন থামুন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চান।
আত্মশুদ্ধিই প্রকৃত সাফল্য
আত্মশুদ্ধি কোনো একদিনের কাজ নয়, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপ, অতিভোজন, অলসতা ও প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসেই আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে পারি। রাসুল (সা.) বলেছেন,
“সেই ব্যক্তি সফল, যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যে ব্যর্থ, যে নিজেকে প্রবৃত্তির হাতে সোপর্দ করে।” (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আত্মশুদ্ধির তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরও পড়ুন: আবু জাহেল কি নবীজির (সা.) চাচা ছিলেন? ইতিহাসের সত্যতা জানুন