সুন্দরবন, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। কিন্তু এই বনের গহীনে যাওয়া মানেই জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। গত ২৫ বছরে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৪২৫ জন, আহত হয়েছেন আরও অনেকেই। অন্যদিকে, বন বিভাগের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে ১০%। কিন্তু এই বৃদ্ধি কি প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের বাঘের জন্য আশার আলো নাকি চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে?
বাঘের আক্রমণ: একের পর এক মৃত্যুর মিছিল
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার আব্দুস সামাদ হাওলাদারের জীবনের গল্প অনেকটাই ভয়াবহ। প্রায় ২৫ বছর আগে সুন্দরবনে কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের আক্রমণের শিকার হন তিনি। গলায় বাঘের কামড়, রক্তাক্ত সংগ্রামের পর বেঁচে ফিরলেও হারাতে হয়েছিল দু’চোখের দৃষ্টি।
২০২৩ সালের অক্টোবরে শিপার হাওলাদার নামে এক জেলে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন। চারদিন পর তার বিচ্ছিন্ন দেহের অংশ পাওয়া যায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে তার মৃত্যু স্ত্রী, শিশু কন্যা ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে ঠেলে দিয়েছে চরম দারিদ্র্যের মুখে।
শুধু শিপার নন, গত দুই দশকে শতাধিক পরিবার এমনই মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয়েছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন ৪২৫ জন, আহত হয়েছেন ৯৫ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি।
ক্ষতিপূরণ নীতিমালা: যথেষ্ট নয়
২০১১ সালে বন্য প্রাণী আক্রমণে ক্ষতিপূরণ নীতিমালা চালু হয়। এর আওতায় নিহতের পরিবার পায় ১ লাখ টাকা, আহতরা পান ৫০ হাজার টাকা এবং সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই সহায়তা অপ্রতুল।
বনজীবী ও পরিবারের সদস্যদের দাবি, শুধু এককালীন ক্ষতিপূরণ নয়, মাসিক ভাতা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক। বিশেষ করে যেসব নারী স্বামী হারিয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন।
বাঘের সংখ্যা বাড়লেও উদ্বেগ কমছে না
বন বিভাগের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৮ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪, আর ২০২৩ সালের জরিপে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫-এ। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে বাঘের সংখ্যা।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও তা যথেষ্ট নয়। ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ সম্মেলনে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল যে ১২ বছরের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। সেই তুলনায় সুন্দরবনের অগ্রগতি ধীর।
বাঘের জন্য হুমকি: জলবায়ু পরিবর্তন, পাচার ও বিষপ্রয়োগ
সুন্দরবনের বাঘ শুধু মানুষের সঙ্গেই সংঘর্ষে জড়াচ্ছে না, বরং নানা প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে তাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে।
-
জলবায়ু পরিবর্তন: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা বাঘের আবাসস্থলকে সংকুচিত করছে।
-
অবৈধ শিকার ও পাচার: আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র বাঘের দেহাংশ পাচারে সক্রিয়।
-
বিষপ্রয়োগ: মাছ শিকারে বিষ ব্যবহারের ফলে বাঘের খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে, এমনকি বিষাক্ত পানি পান করেও মারা যাচ্ছে বাঘ।
বন বিভাগের উদ্যোগ: ফেন্সিং, টাস্কফোর্স ও সচেতনতা
বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব কমাতে বন বিভাগ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে:
-
ফেন্সিং নির্মাণ: সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ৭৪ কিলোমিটার ফেন্সিং করার কাজ চলছে, ইতিমধ্যে ৬০ কিলোমিটার সম্পন্ন হয়েছে।
-
ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম (VTRT): স্থানীয়দের নিয়ে গঠিত এই টিম দ্রুত বাঘের আক্রমণ মোকাবিলা করে।
-
সচেতনতা কার্যক্রম: বনজীবী ও স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ব বাঘ দিবসে আলোচনা: সুন্দরবন বাঁচাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন
গত ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস উপলক্ষ্যে বাগেরহাটের মোংলায় ‘সুন্দরবন বাঁচাও, বাঘ বাঁচাও’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ও অবৈধ শিকার রোধে জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
“বাঘ আমাদের গর্বের প্রতীক, সাহসের প্রতীক। সুন্দরবন বাঁচলে বাঘ বাঁচবে, বাঘ বাঁচলে বন বাঁচবে।”
— কৃষিবিদ মো. শামীমুর রহমান শামীম
উপসংহার: সমন্বিত উদ্যোগই পারে সুন্দরবন ও বাঘ রক্ষা করতে
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ। বাঘ রক্ষা করতে হলে বনের জীববৈচিত্র্য, নিরাপত্তা ও স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ক্ষতিপূরণ বাড়ানো, বিকল্প আয়বর্ধক কর্মসূচি চালু এবং বন অপরাধ দমনে কঠোর নজরদারি— এই তিন দিকেই জোর দিতে হবে।
সুন্দরবন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় আমাদের সকলের সচেতনতা ও অংশগ্রহণই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই অমূল্য সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের কৃষকদের সংকট: ন্যায্য মজুরি ও টেকসই কৃষি