বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি বড়সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষকের সংকট (পদ শূন্য) রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা, যা শিশুদের শিক্ষাজীবনের ভিত্তি গড়ে তোলে, সেখানে প্রশাসনিক নেতৃত্বের এমন ঘাটতি শুধু পাঠদানেই ব্যাঘাত ঘটায় না, বরং শিক্ষার মানেও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
প্রধান শিক্ষক সংকটের পরিসংখ্যান
দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার ৫৬৯টি। তবে এর মধ্যে ৩৪ হাজার ১০৬টি স্কুলে প্রধান শিক্ষক নেই। বর্তমানে মাত্র ৩১ হাজার ৩৯৬ জন প্রধান শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। উল্লেখযোগ্য হলো, এই পদগুলোর মধ্যে ৩১ হাজার ৪৫৯টি পদ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণের কথা থাকলেও মামলা জটিলতার কারণে তা আটকে রয়েছে।
শূন্য পদে ভারপ্রাপ্তদের উপর নির্ভরতা
প্রধান শিক্ষক না থাকায়, অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সহকারী শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ঐ শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্বের পাশাপাশি পাঠদান চালিয়ে যেতে হচ্ছে, যা কার্যকর পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় মনোযোগ পাচ্ছে না এবং শিক্ষা গ্রহণে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন, প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদগুলো দ্রুত পূরণ করতে হবে। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী, অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার দিয়ে এবং নতুনদের সুযোগ দিয়ে ক্যাটাগরি ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২,৬৪৭টি পদ সরাসরি নিয়োগযোগ্য। এর মধ্যে ২,৩৮২টি পদে নিয়োগের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (PSC) খুব শিগগিরই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে।
মামলা জটিলতা ও ইতিহাস
২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়। তবে গেজেট প্রকাশে অসঙ্গতি থাকায় অনেক শিক্ষককে সহকারী শিক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও তাঁরা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ নিয়ে মামলা হয় এবং তা এখনো উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
এই আইনি জটিলতা বর্তমানে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও একটি পক্ষ মামলায় রায় পেয়েছে, তবে সরকারের আপিল করার কারণে রায় কার্যকর হয়নি।
বাস্তব প্রভাব: শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ
গ্রামাঞ্চলের অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট প্রকট। কোথাও কোথাও দু-তিনজন শিক্ষক দিয়ে পাঁচটি শ্রেণি চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে প্রশাসনিক ব্যস্ততা, প্রশিক্ষণ বা ছুটির কারণে শিক্ষকদের উপস্থিতির হারও কমে যাচ্ছে। ফলে নিয়মিত পাঠদান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষায় পিছিয়ে রাখছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিখন ঘাটতির প্রভাব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় গিয়ে আরও গভীর হয়, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দক্ষতা ও সক্ষমতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
করণীয় ও সুপারিশ
-
মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি: আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে শিগগির আপিল নিষ্পত্তি হলে পদোন্নতির পথ সুগম হবে।
-
প্রক্রিয়াজাত নিয়োগ বাস্তবায়ন: যেসব পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া সম্ভব, তা দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।
-
প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন: নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ও পদোন্নতিপ্রাপ্তদের জন্য প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
-
শিক্ষকের কাজের চাপ কমানো: প্রশাসনিক কাজের চাপ কমিয়ে তাদের মূল দায়িত্ব, অর্থাৎ পাঠদানে মনোযোগী করার জন্য আলাদা প্রশাসনিক সহায়তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
উপসংহার
শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য শুধু শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানোই নয়, তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দক্ষ প্রধান শিক্ষক নিশ্চিত করাও জরুরি। প্রধান শিক্ষকের পদে শূন্যতা শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি একটি প্রজন্মের শিক্ষা প্রাপ্তির অধিকারকে ব্যাহত করছে। এই সংকট নিরসনে সরকার, প্রশাসন ও আদালতের সমন্বিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বেনজীর আহমেদের ডিবিএ ডিগ্রি স্থগিত: কী ঘটেছে জানুন