বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখটি এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে। ওই দিন রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন। এই ঘোষণাপত্রে উঠে এসেছে দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং জাতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা। এতে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ঘোষণাপত্রের উৎপত্তি
বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরশাসন, একদলীয় শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আশির দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ১/১১ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি—সবকিছুই একটি সুদীর্ঘ প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ।
গত ১৬ বছরের শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থান অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে একটি গণজাগরণে রূপ নেয়। জনগণের দাবির মুখে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভার সাময়িকভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে হস্তান্তরিত হয়।
ঘোষণাপত্রের মূল বিষয়বস্তু
ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক লড়াইকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মূল পয়েন্টগুলো নিম্নরূপ:
-
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোর ধারাবাহিকতা তুলে ধরা হয়েছে।
-
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের “জাতীয় বীর” হিসেবে ঘোষণা এবং তাঁদের পরিবার ও আহতদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
-
একদলীয় শাসনব্যবস্থার অবসান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়েছে।
-
ঘোষিত হয়েছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পুনর্গঠিত জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার আনার অঙ্গীকার।
-
দুর্নীতি, বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতির সুপারিশ করা হয়েছে।
-
পরিবেশ, জলবায়ু এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার রক্ষার জন্য একটি পরিবেশবান্ধব রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন
ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, দেশের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক শূন্যতা দূর করতে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে এই সরকার দায়িত্ব নেয়। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে নতুন নির্বাচনের আয়োজন, সাংবিধানিক সংস্কার প্রক্রিয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
ছাত্র-জনতার ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই অভ্যুত্থান ছিল শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক আন্দোলন নয়; বরং এটি ছিল একটি মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রয়াস। জনগণের স্পষ্ট দাবি—একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, বৈষম্যহীন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ।
ঘোষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, পরবর্তী সরকার গঠনের পর এই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রকে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই আন্দোলনের গুরুত্ব ও মূল্য অনুধাবন করতে পারে।
উপসংহার
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ শুধু একটি রাজনৈতিক ঘোষণাই নয়, বরং এটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার দলিল। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং একটি উন্নত, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি এই ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এই ঐতিহাসিক দলিল আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—যদি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়, তবে কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তি কখনও টিকে থাকতে পারে না।
আরও পড়ুন: গাজায় শিশুদের উপর ইসরায়েলের নির্মম হামলা: প্রতিদিন ২৮ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে