এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে পাল্টে গেছে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারায় দীর্ঘদিন শাসন করা আওয়ামী লীগ সরকার। এই রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলনের পর এক বছরের মধ্যে দেশে নানান গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও রাজনৈতিক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
মামলা ও গ্রেফতার: সংখ্যায় নজিরবিহীন
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র অনুযায়ী, রাজধানীতে গত এক বছরে ৭০৬টি মামলা রুজু হয়েছে, যার বেশিরভাগই হত্যা, হামলা, ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০২টি মামলায়। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার ৭৯ জন ব্যক্তি, যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও পেশাজীবীসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ৭৩ জনের অধিক সাবেক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। এর মধ্যে কিছু মামলার বিচার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৩৫১টি মামলা
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও দায়ের হয়েছে ৩৫১টি মামলা। যার মধ্যে রয়েছে ২১৪টি হত্যা মামলা। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়। টিআইবি (ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) বলছে, ওই সময়ের সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১,৪০০ জন ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি।
দুর্নীতি ও আর্থিক অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর এক বছরে মোট ১২,৮২৭টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৩৯৯টি অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে, যেখানে অভিযুক্ত হয়েছেন সাবেক এমপি, মন্ত্রীসহ ১,২৬৪ জন। আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, অনেক সাবেক নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম জানিয়েছেন, দুর্নীতি ও সম্পদ লোপাট সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার দ্রুত শেষ করার লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
আদালত ও আইনি প্রক্রিয়া: জামিন ও পুনরায় গ্রেফতার
যদিও কিছু রাজনীতিক জামিন পেয়েছেন, তবে অধিকাংশই এখনো মুক্তি পাননি। অনেকের বিরুদ্ধে জামিনের পরপরই পুনরায় নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আইনজীবীরা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, দাবি করেছেন যে, জামিন প্রাপ্তি সত্ত্বেও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আসামিদের নতুন মামলায় জড়ানো হচ্ছে।
রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ
গত এক বছরে পাল্টে গেছে রাজনীতির মানচিত্র। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে, অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছে, এমনটাই বলা হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
তবে, বিভিন্ন স্তরে এখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মামলার নামে হয়রানি এবং দুর্নীতির মামলায় ‘নির্বাচিত অভিযুক্ত’ করার অভিযোগ থাকছে। গণতন্ত্রের অভিযাত্রা যেন পক্ষপাতদুষ্ট না হয়, সে বিষয়েও সচেতন থাকার দাবি জানাচ্ছে নাগরিক সমাজ।
শেষ কথা
২০২৪ সালের অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর এক বছরে ঘটে যাওয়া আইনি, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে। তবে এই পথ চলায় প্রয়োজন আইনের নিরপেক্ষতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সকল পক্ষের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
আরও পড়ুন: জুলাই ঘোষণাপত্র ২০২৪: গণঅভ্যুত্থানের প্রতিফলন ও জাতীয় বীরদের স্বীকৃতি