গণমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। কিন্তু এই স্তম্ভ যখন নানাবিধ হুমকি ও চাপের মুখে পড়ে, তখন সমাজে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ব্যাহত হয়। সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং সার্বিকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং এটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অপরিহার্য শর্ত। নোয়াবের প্রেসিডেন্ট এ কে আজাদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা যে গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেখানে মত প্রকাশ ও তথ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত এক বছরে (আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫) ৪৯৬ জন সাংবাদিক নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও, দায়িত্ব পালনকালে ৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ২৪ জন গণমাধ্যমকর্মীকে পদচ্যুত করা হয়েছে এবং ৮টি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তাপ্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
দৈনিক জনকণ্ঠের ঘটনা: একটি উদ্বেগজনক প্রেক্ষাপট
সম্প্রতি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার কার্যালয়ে একদল লোকের অবৈধ অনুপ্রবেশ ও হুমকির ঘটনা গণমাধ্যম জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। নোয়াবের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “কর্মীদের কোনো দাবি থাকলে তা শ্রম আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। অথবা সংবাদগত কোনো বিরোধ থাকলে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করা যেতে পারে। কিন্তু পত্রিকার কার্যালয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
এ ধরনের ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যই হুমকি নয়, বরং এটি সমগ্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য একটি বিপদসংকেত।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় করণীয়
নোয়াবের পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত দাবিগুলো উত্থাপন করা হয়েছে:
-
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: সাংবাদিকরা যেন তাদের দায়িত্ব পালনকালে কোনো রকম হুমকি বা হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
-
গণমাধ্যমে ‘মব কালচার’ বন্ধ করা: কোনো প্রতিষ্ঠানে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ বা হুমকি দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।
-
আইনের শাসন নিশ্চিত করা: সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা বা হয়রানির ঘটনাগুলো দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
-
প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা শক্তিশালী করা: সংবাদমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রেস কাউন্সিলকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
একটি দেশ তখনই প্রকৃত গণতান্ত্রিক হয়, যখন সেখানে সংবাদমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। নোয়াবের উদ্বেগ শুধু একটি পেশাগত গোষ্ঠীরই নয়, বরং এটি সমগ্র সমাজের উদ্বেগ। কারণ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হারালে জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারও সংকুচিত হয়ে পড়ে।
সরকার, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আশা করা যায়, নোয়াবের এই উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: গাজীপুরে সাংবাদিককে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা
মন্তব্য করুন: আপনার এলাকায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কী মনে হয়? নিচে কমেন্টে শেয়ার করুন।