দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের পথে সরকার। পুলিশ বাহিনীতে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগকে ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে খসড়া প্রস্তুতির কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে, যা পুলিশ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।
স্বাধীন পুলিশ কমিশন কী এবং কেন প্রয়োজন?
স্বাধীন পুলিশ কমিশন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, যার মূল উদ্দেশ্য পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এই কমিশন পুলিশের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং শাস্তি প্রক্রিয়ায় নীতি নির্ধারণ করবে। এছাড়াও, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগ তদন্ত ও নিষ্পত্তি করাও এর অন্যতম দায়িত্ব।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পুলিশিং ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি এবং জবাবদিহিতার অভাব লক্ষ্য করা গেছে। স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম
প্রস্তাবিত কমিশনের প্রধান হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। এছাড়াও, কমিশনে থাকবেন:
-
সংসদীয় দলগুলোর প্রতিনিধি
-
মানবাধিকার কর্মী
-
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও বিচারিক কর্মকর্তা
-
পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা
কমিশনের সদস্য নির্বাচনের জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং হাইকোর্টের একজন বিচারপতি থাকবেন।
কমিশনের প্রধান দায়িত্ব
১. পুলিশের নিয়োগ ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা: নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন।
২. অভিযোগ নিষ্পত্তি: পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের অভিযোগ দ্রুত তদন্ত ও নিষ্পত্তি।
৩. শাস্তি ও পুরস্কার নির্ধারণ: পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা পুরস্কারের সুপারিশ করা।
৪. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ: পুলিশের কাজে বেআইনি প্রভাব বা হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে নির্দেশনা প্রদান।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, “স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন জরুরি, কিন্তু শুধু গঠন করলেই হবে না। এর সদস্যদের নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশিং ব্যবস্থায় বহুক্ষেত্রে আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় প্রয়োজন।”
তিনি আরও যোগ করেন, “কমিশন যদি সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে, তবে এর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। তাই গঠন প্রক্রিয়ায় সকল স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।”
আগের সরকারগুলোর ভূমিকা
২০০৭ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ’ প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই সংস্কার প্রক্রিয়া আলোচনায় এলেও বাস্তবায়িত হয়নি। গত ১৫ বছর ধরে পুলিশ বাহিনীতে রাজনৈতিক প্রভাব, অবৈধ অর্থ লেনদেন এবং পদোন্নতিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
২০২৩ সালে ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর পুলিশ সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে এর সফলতা নির্ভর করবে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর:
-
নিরপেক্ষতা: কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
-
কার্যকর তদন্ত: অভিযোগ দ্রুত ও নিষ্পক্ষভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে।
-
জনবিশ্বাস: পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
শেষ কথা
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি পুলিশ বাহিনীকে আরও পেশাদার, জবাবদিহিতামূলক ও জনগণের সেবায় নিবেদিত করতে সহায়তা করবে। তবে, এর সফল বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা এবং সকল স্তরের সমন্বয় প্রয়োজন।
এই সংস্কার যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের পুলিশিং ব্যবস্থা একটি নতুন দিগন্তে প্রবেশ করবে, যা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও উন্নত করবে।
আরও পড়ুন: জুলাই সনদ ২০২৫: বিএনপির আপত্তি ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের নতুন দিগন্ত