আধুনিক জীবনযাত্রার নীরব সঙ্গী হয়ে উঠেছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত ওজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ। ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সবার নজর রাখা উচিত।
তবে আশার কথা হলো—জীবনযাত্রায় কিছু ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত পরিবর্তন আনতে পারলেই ডায়াবেটিস ও অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এটি কোনো জটিল বিজ্ঞান নয়, বরং সুশৃঙ্খল ও সচেতন জীবনযাপনের অংশ।
চলুন জেনে নিই এমন ৭টি ব্যবহারিক কৌশল যা আপনাকে এই যাত্রায় সহায়তা করতে পারে।
১. প্রকৃত ক্ষুধাকে চিনুন: Emotional Eating এড়িয়ে চলুন
আমরা অনেক সময়ই পেটের প্রকৃত ক্ষুধার কারণে নয়, বরং একঘেয়েমি, চাপ বা আনন্দের মুহূর্তে সঙ্গ দিতে খাবার খাই। এটিকে বলা হয় Emotional Eating।
কী করবেন? খাবার খাওয়ার আগে নিজেকে একটি প্রশ্ন করুন:
“আমার কি সত্যিই পেটে ক্ষুধা লেগেছে, নাকি এটি কেবল একটি মুড?”
যদি উত্তরটি মানসিক চাহিদা হয়, তাহলে এক গ্লাস পানি পান করুন, সামান্য হাঁটুন বা বই পড়ুন। এভাবে আপনি অপ্রয়োজনীয় ক্যালরি গ্রহণ এড়াতে পারবেন।
২. হাইড্রেশনকে অগ্রাধিকার দিন
পানি আমাদের শরীরের বিপাক ক্রিয়া সচল রাখতে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কী করবেন?
প্রতিটি প্রধান খাবারের আধা ঘণ্টা আগে ১–২ গ্লাস পানি পান করার অভ্যাস করুন।
এতে পাকস্থলী আংশিক পূর্ণ হবে, ফলে স্বাভাবিকের তুলনায় কম খাবেন।
পানি শরীর থেকে টক্সিন বের করতে এবং মেটাবলিজম বাড়াতে সহায়ক।
৩. খাদ্যতালিকায় ফাইবার ও প্রোটিন বাড়ান
রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট ও চিনিযুক্ত খাবার রক্তে গ্লুকোজ দ্রুত বাড়িয়ে আবার কমিয়ে দেয়। এতে দ্রুত ক্ষুধা লাগে। অন্যদিকে, ফাইবার ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার ধীরে হজম হয়, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা অনুভূতি দেয়।
কী করবেন?
সাদা ভাত বা রুটির পরিবর্তে লাল চাল, ঢেঁকিছাটা চাল বা গমের রুটি খান।
প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে শাকসবজি, ডাল, বাদাম, মাছ ও ডিমকে অগ্রাধিকার দিন।
৪. Mindful Eating অনুশীলন করুন
টিভি, মোবাইল বা ল্যাপটপ দেখতে দেখতে দ্রুত খাওয়া আধুনিক জীবনের একটি সাধারণ সমস্যা। এটি অজান্তেই অতিরিক্ত খাওয়ার কারণ হয়।
কী করবেন?
খাওয়ার সময় সব ধরনের distraction থেকে দূরে থাকুন।
খাবারের রং, গন্ধ, স্বাদ ও texture উপভোগ করুন।
প্রতিটি কণা ধীরে ধীরে চিবিয়ে খান।
এতে মস্তিষ্ক সময়মতো “পেট ভরে গেছে” সংকেত পাবে, ফলে আপনি কম খেয়েও তৃপ্তি পাবেন।
৫. নিয়মিত শারীরিক কার্যক্রমে যুক্ত হোন
ব্যায়াম মানেই শুধু জিমে যাওয়া নয়। দৈনন্দিন জীবনে অল্প কিছু movement-ও বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।
কী করবেন?
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট মাঝারি ধরনের শারীরিক কার্যক্রম করুন—যেমন দ্রুত হাঁটা, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা।
অফিসে লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
দীর্ঘ সময় বসে থাকলে প্রতি ৩০–৪৫ মিনিট পর উঠে সামান্য হাঁটুন।
এই ছোট ছোট অভ্যাস শরীরের insulin sensitivity বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৬. মানসিক চাপ (Stress) নিয়ন্ত্রণ করুন
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়ায়। এর ফলে রক্তে শর্করা বেড়ে যায় এবং লবণাক্ত ও মিষ্টি খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে।
কী করবেন?
প্রতিদিন অন্তত ১০–১৫ মিনিট মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম করুন।
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন, যা stress management-এর সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
৭. পর্যাপ্ত ঘুম (Quality Sleep) নিন
গভীর ও পর্যাপ্ত ঘুম মেটাবলিজম ও হরমোন নিয়ন্ত্রণের জন্য অপরিহার্য। ঘুমের অভাব ক্ষুধা বাড়ায় এমন হরমোন Ghrelin বৃদ্ধি করে এবং পূর্ণতার সংকেত দেয় এমন হরমোন Leptin হ্রাস করে।
কী করবেন?
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও জাগার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকুন।
শোবার ঘর অন্ধকার, শান্ত ও ঠান্ডা রাখুন।
সর্বোপরি: ধারাবাহিকতাই সাফল্যের চাবিকাঠি
হঠাৎ করে সবকিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা না করে ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। যেমন—প্রথম সপ্তাহে পানির অভ্যাস, পরের সপ্তাহে হাঁটার অভ্যাস। ধীরে ধীরে এগোতে থাকুন।
ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণ কোনো অস্থায়ী ডায়েট প্ল্যান নয়, বরং এটি একটি Sustainable Lifestyle Change। ছোট ছোট পদক্ষেপই একদিন নিয়ে যাবে বড় অর্জনের দিকে।
সারসংক্ষেপ:
ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র হলো—সচেতন খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান, সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও ভালো ঘুম। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ধৈর্য এবং ধারাবাহিকতা। তাহলেই আপনি পাবেন একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবন।
আরও পড়ুন: ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ছাড়ালো ২৭ হাজার | সর্বশেষ আপডেট