বাংলাদেশের কক্সবাজারে আবারও নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে। সীমান্তের নাফ নদ পার হয়ে ভেলায় ভেসে কিংবা দালালের সহায়তায় নৌপথে আসছে তারা। বিজিবি সীমান্তে নজরদারি জোরদার করলেও প্রতিদিনই ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ঢুকে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলোতে চাপ আরও বাড়ছে।
সীমান্তে কঠোর নজরদারি, তবুও অনুপ্রবেশ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সরকারি সেনাদের মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে। অনেকেই সীমান্ত ঘেঁষে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। বিজিবি জানিয়েছে, সীমান্তে টহল ও নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও বিভিন্ন চোরাই পথে কিংবা ভেলায় ভেসে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে ঢুকে পড়ছে। স্থানীয় সূত্র বলছে, গত কয়েক দিনে শতাধিক রোহিঙ্গা নাফ নদ পাড়ি দিয়ে উখিয়া ও টেকনাফে প্রবেশ করেছে।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গার বর্তমান সংখ্যা
সরকারি হিসাবে বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে প্রায় ১২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এর মধ্যে প্রায় আট লাখ ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। তবে নতুন করে আসা অনেকের নাম এখনো সরকারি তালিকায় নেই। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত এক বছরে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।
রোহিঙ্গাদের দাবি : নিজ দেশে ফেরার সুযোগ
রোহিঙ্গারা জানাচ্ছে, তারা বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে থাকতে চায় না। তাদের একটাই আকাঙ্ক্ষা—নিজেদের মাতৃভূমি রাখাইন রাজ্যে নিরাপদে ফিরে যাওয়া। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সংগঠন কমিটি ফর পিস অ্যান্ড রিপ্যাট্রিয়েশন (আরসিপিআর) সক্রিয়ভাবে প্রত্যাবাসনের দাবি জানাচ্ছে। সংগঠনের সভাপতি দীল মোহাম্মদ বলেন, “আমাদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু একটি বিষয়ে আমরা এক—আমাদের দেশে ফিরতে চাই। রোহিঙ্গাদের চূড়ান্ত পরিচয় হচ্ছে আরাকানের রোহিঙ্গা।”
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের দুঃসহ জীবন
রাখাইন রাজ্যে এখনো রোহিঙ্গারা নানা নির্যাতনের শিকার। আরাকান আর্মির সদস্যরা স্থানীয়দের গাছপালা কেটে বিক্রি করছে, গরু-ছাগল দখল করছে এবং কৃষিকাজ ও মাছ চাষের ওপর ট্যাক্স আদায় করছে। এমনকি বিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও মাসিক চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এতে করে রোহিঙ্গারা সেখানে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কক্সবাজার সফর : আশার আলো
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ২৫ আগস্ট কক্সবাজার সফরে আসবেন বলে জানা গেছে। তাঁর সফরকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ সফর মূলত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার অংশ হিসেবেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সীমান্তে অনিশ্চয়তা বাড়ছে
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, সীমান্তে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এখনো অবস্থান করছে। অনেকে ভেলায় চড়ে নাফ নদ পার হওয়ার চেষ্টা করছে। মংডু সীমান্তে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় সীমান্ত পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।
উপসংহার
রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো একজন রোহিঙ্গাকেও স্বেচ্ছায় ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। নতুন করে অনুপ্রবেশের ফলে কক্সবাজারের চাপ আরও বাড়ছে। তবে রোহিঙ্গাদের একটাই বার্তা—তারা শান্তিপূর্ণভাবে আরাকানে ফিরতে চায়। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার কক্সবাজার সফর এই সংকট সমাধানে কোনো কার্যকর পথ তৈরি করতে পারে কি না, এখন সেটাই দেখার বিষয়।