বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা একটি জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খাত। জমি কেনা-বেচা, দখল, মালিকানা বা উত্তরাধিকার—সব ক্ষেত্রেই ভূমি সম্পর্কিত দলিলপত্রের প্রমাণ হিসেবে খতিয়ান অত্যন্ত জরুরি। খতিয়ান হলো ভূমির দখল বা ব্যবহারকারীর প্রমাণপত্র, যা ভূমি সংস্কার বোর্ড থেকে প্রস্তুত করা হয়। তবে অনেক সময় খতিয়ানে করণিক ভুল বা Clerical Error দেখা দেয়, যা সংশোধনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ খতিয়ানের করণিক ভুল সংশোধনে সেবাগ্রহীতাকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক খতিয়ান আসলে কী, কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ, করণিক ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া কী এবং সাধারণ মানুষ কীভাবে খতিয়ান সম্পর্কিত সেবা নিতে পারবেন।
খতিয়ান কী?
খতিয়ান হলো একটি সরকারি দলিল যেখানে কোনো নির্দিষ্ট জমির দখল, ব্যবহারকারী ও সম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে। সহজভাবে বলতে গেলে, জমির কে ব্যবহার করছে বা কে দখলদার, তা প্রমাণের জন্য খতিয়ান ব্যবহৃত হয়। তবে মনে রাখতে হবে—
খতিয়ান মালিকানার দলিল নয়।
এটি শুধুমাত্র দখলের প্রমাণপত্র।
জমির প্রকৃত মালিকানা নিশ্চিত করতে রেজিস্ট্রিকৃত দলিল, খতিয়ান ও অন্যান্য নথিপত্র মিলিয়ে দেখতে হয়।
খতিয়ানের ধরন
বাংলাদেশে মূলত তিন ধরনের খতিয়ান প্রচলিত আছে।
সি.এস. খতিয়ান (Cadastral Survey):
প্রথম দফা ভূমি জরিপে তৈরি খতিয়ান। এটি পুরনো হলেও এখনো অনেক জায়গায় প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।আর.এস. খতিয়ান (Revisional Survey):
সি.এস. জরিপের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে তৈরি খতিয়ান। এতে আপডেটেড তথ্য যুক্ত থাকে।বি.এস. খতিয়ান (Bangladesh Survey):
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার নতুন করে যে জরিপ চালু করে তার ফলাফলে তৈরি খতিয়ান। এটি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
এ ছাড়া কিছু অঞ্চলে পিএস (Parcha Survey) বা স্থানীয় জরিপভিত্তিক খতিয়ানও প্রচলিত আছে।
খতিয়ানের গুরুত্ব
বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় খতিয়ান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে—
জমির দখল প্রমাণ করা যায়।
জমি কেনা-বেচার সময় যাচাই করা যায়।
উত্তরাধিকার সূত্রে জমির হিসাব মিলানো সহজ হয়।
ভূমি বিরোধ কমাতে সহায়তা করে।
সরকারী ভূমি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় খতিয়ান অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
করণিক ভুল (Clerical Error) কী?
অনেক সময় খতিয়ানে নাম, জমির পরিমাণ, দাগ নম্বর বা অন্যান্য তথ্য ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয়। এটিই করণিক ভুল হিসেবে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ—
মালিকের নামের বানান ভুল হওয়া।
জমির পরিমাণে সামান্য পার্থক্য থাকা।
ভুল দাগ নম্বর উল্লেখ হওয়া।
এসব ভুল প্রকৃত মালিকানা বা দখল পরিবর্তন করে না, তবে ভবিষ্যতে বিভ্রান্তি ও বিরোধের সৃষ্টি করে। তাই করণিক ভুল সংশোধন করা জরুরি।
খতিয়ান সংশোধনে সর্বোচ্চ সেবার নির্দেশনা
২৬ আগস্ট ২০২৫ রাজধানীর ভূমি ভবনে আয়োজিত এক কর্মশালায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ বলেন—
খতিয়ান মালিকানার দলিল নয়, বরং দখলের প্রমাণ।
খতিয়ানে ভুল থাকলেও প্রকৃত মালিকের মালিকানা অক্ষুণ্ণ থাকে।
করণিক ভুল সংশোধনে সেবাগ্রহীতাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিতে হবে।
এই কর্মশালায় আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত সচিব মো. এমদাদুল হক চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান এবং প্রকল্প পরিচালক মো. পারভেজ হাসান।
খতিয়ান সংশোধনের প্রক্রিয়া
যদি কারো খতিয়ানে করণিক ভুল থাকে, তবে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় তা সংশোধন করা যায়।
আবেদন: ভূমি অফিসে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়।
প্রমাণপত্র জমা: দলিল, পূর্ববর্তী খতিয়ান, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হয়।
যাচাই-বাছাই: ভূমি কর্মকর্তা জমির রেকর্ড যাচাই করেন।
সংশোধন: সঠিক প্রমাণ মিললে খতিয়ানে করণিক ভুল সংশোধন করা হয়।
ডিজিটাল সিস্টেমে এন্ট্রি: এখন অটোমেটেড ভূমি সেবা সিস্টেমে এসব তথ্য আপডেট করা হচ্ছে।
অনলাইনে খতিয়ান যাচাই করার উপায়
বর্তমানে নাগরিকরা সহজেই অনলাইনে খতিয়ান যাচাই করতে পারেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে জেলা, উপজেলা, মৌজা ও দাগ নম্বর দিয়ে অনলাইনে খতিয়ান দেখা যায়। এতে সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
যদিও খতিয়ান ব্যবস্থা ডিজিটাল হচ্ছে, তবে এখনো অনেক জায়গায় জনসচেতনতার অভাব, দুর্নীতি ও টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে জনগণ ভোগান্তি পোহান। সরকার ভবিষ্যতে—
সম্পূর্ণ খতিয়ান অনলাইনে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে।
ভূমি বিরোধ কমাতে ভূমি আদালতের সংস্কার চলছে।
জনসচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রচার ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
উপসংহার
খতিয়ান হলো জমির দখল প্রমাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল। করণিক ভুল থাকলেও তা মালিকানা পরিবর্তন করে না, তবে বিভ্রান্তি এড়াতে এসব ভুল দ্রুত সংশোধন করা জরুরি। সরকার ইতোমধ্যে অনলাইন সিস্টেম চালু করেছে এবং সেবাগ্রহীতাকে সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দিয়েছে। সঠিকভাবে খতিয়ান সংরক্ষণ ও যাচাই করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভূমি বিরোধ থেকে অনেকাংশে মুক্তি পাবে।