বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন, যেখানে প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণী একসাথে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য স্বর্গরাজ্য। নদীর ঢেউ ভেঙে এগিয়ে চলা নৌকা, চারপাশে ঘন সবুজে মোড়ানো বন, হঠাৎ কোথাও হরিণের শান্ত পদচারণা বা বানরের লাফঝাঁপ—সব মিলিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আর দূর থেকে যদি শোনা যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন, তবে সেই মুহূর্ত হবে জীবনের অন্যতম রোমাঞ্চকর স্মৃতি।
সুন্দরবনের আয়তন ও গুরুত্ব
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবনের মধ্যে বাংলাদেশের অংশ হলো প্রায় ৬,৫১৭ বর্গকিলোমিটার। এটি খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, উপকূলীয় মানুষের জীবন ও পরিবেশ রক্ষায় সুন্দরবনের ভূমিকা অপরিসীম। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় এটি এক প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে।
সুন্দরবনের গাছপালা
এখানে রয়েছে নানা ধরনের ম্যানগ্রোভ গাছ—সুন্দরী, গরান, কেওড়া ও গোলপাতা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই গাছগুলো লবণাক্ত মাটিকে ধরে রাখে এবং উপকূলীয় অঞ্চলকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। গাছের জটিল শেকড় এবং ছায়াঘেরা পরিবেশ পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে।
বন্যপ্রাণীর সমাহার
সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশ অংশে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা প্রায় ১২৫। এ ছাড়া এখানে রয়েছে স্পটেড ডিয়ার, বন্যশূকর, ম্যানগ্রোভ ওটার, ফিশিং ক্যাট, লোনা পানির কুমির, অজগর সাপ এবং নানা ধরনের পাখি। ভ্রমণের সময় ভাগ্য ভালো থাকলে এদের অনেককেই কাছ থেকে দেখা সম্ভব।
নৌকাভ্রমণের অভিজ্ঞতা
সুন্দরবন ভ্রমণের আসল স্বাদ পেতে হলে নৌকাভ্রমণ অবশ্যই করতে হবে। সরু খালের ভেতর দিয়ে নৌকা ভেসে চলার সময় চারপাশের প্রকৃতি যেন জীবন্ত কোনো চিত্রকর্মের মতো মনে হয়। ছোট ডিঙি নৌকা বা বড় ট্রলারে বসে নদী ও খালের সৌন্দর্য উপভোগ করা এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
দর্শনীয় স্থান
ডুবলার চর: প্রতি বছর কার্তিক মাসে এখানে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মৎস্যজীবী ও ভক্তরা মিলিত হয়ে উৎসব পালন করেন।
পুটনী দ্বীপ: এখানকার লাল কাঁকড়ার পদচারণা এবং সমুদ্রবালির বিস্তৃত সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
কোটকা ও কচিখালী: বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য জনপ্রিয় স্থান।
সুন্দরবনে যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণের জনপ্রিয় রুট হলো খুলনা বা মংলা হয়ে প্রবেশ। ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন বা লঞ্চে খুলনা পৌঁছে সেখান থেকে ট্রলার বা লঞ্চে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্পটে যাওয়া যায়। চাইলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর দিয়েও যাত্রা করা সম্ভব। বর্তমানে অনেক ট্যুর অপারেটর ৩ দিন ২ রাতের প্যাকেজ ট্যুর অফার করে, যার খরচ সাধারণত ৭-৯ হাজার টাকার মধ্যে থাকে।
সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
সুন্দরবন শুধু পর্যটনের জন্য নয়, বরং দেশের জন্য এক অপরিহার্য সম্পদ। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত লবণাক্ততা এবং অবৈধ বনকাটা সুন্দরবনের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয়দের বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করা গেলে বন সংরক্ষণ আরও সহজ হবে।
উপসংহার
সুন্দরবন ভ্রমণ মানে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ নয়, বরং দেশের এক অমূল্য সম্পদের সাথে পরিচিত হওয়া। রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে অজস্র বন্যপ্রাণী, নদী-খাল আর ম্যানগ্রোভ গাছের মেলবন্ধন—সব মিলিয়ে সুন্দরবন এক অনন্য অভিজ্ঞতার নাম। তাই প্রকৃতিপ্রেমী যে কারও জীবনে অন্তত একবার সুন্দরবনে ঘুরে আসা উচিত।
আরও পড়ুন: ঢাকায় হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা, তাপমাত্রা কমতে পারে