বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে আলোচনায় সম্প্রতি যে খবরটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে তা হলো—এক ব্যবসায়ী পরিবারের ব্যাংক লেনদেন। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) জানিয়েছে, ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং শিপিং ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে খোলা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে।
বিএফআইইউ’র আগস্ট মাসে প্রণীত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, এত বিপুল অঙ্কের টাকা স্থানান্তর সন্দেহজনক এবং অর্থপাচারসহ অনিয়মের ইঙ্গিত বহন করে। এ কারণেই পুরো বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর কাছেও পাঠানো হয়েছে, যেখানে প্রাথমিক যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলছে।
পরিবারের সদস্যদের নামে শতাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
প্রতিবেদন অনুযায়ী, শওকত আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীন, মেয়ে জারা নামরীন এবং ছেলে জারান আলী চৌধুরীর নামে ২৮টি ব্যাংকে মোট ১৮৭টি অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে—
শওকত আলী চৌধুরীর নামে ১৪টি,
তার স্ত্রীর নামে ১৫টি,
মেয়ে জারার নামে ৯টি,
ছেলে জারানের নামে ৩টি,
এবং পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ১৪৬টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, এসব অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা এবং একই সময়ে উত্তোলন হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। স্থিতি ছিল প্রায় ১ হাজার ৭৩ কোটি টাকা।
ব্যবসা ও অর্থ লেনদেনের অসঙ্গতি
বিএফআইইউ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শওকত আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন এসএন করপোরেশন নামের প্রতিষ্ঠান ২০১২ সাল থেকে স্ক্র্যাপ ভেসেল আমদানি করে আসছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আমদানি করা জাহাজ আসলেই চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে কিনা সে বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি কিছু ভেসেলের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট পাওয়া গেছে, যা সন্দেহ বাড়িয়েছে।
এছাড়া, বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনের তথ্যও পাওয়া গেছে, যা আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং ঝুঁকির দিক থেকে উদ্বেগজনক।
সন্দেহজনক ব্যক্তিগত লেনদেন
শওকত আলী চৌধুরীর এক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে একাই জমা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা।
তার ব্যক্তিগত ইবিএল সেভিংস হিসাব থেকে একাধিকবার ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি নগদ অর্থ উত্তোলন করেছেন, যা ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত।
মেয়ে জারা নামরীনের নামে খোলা একটি অ্যাকাউন্টে এক মাসেই ৩১ কোটি টাকা জমা হয়, যা তার আয়-উৎসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ছেলে জারান আলী চৌধুরীর নামে ছাত্র অবস্থায় খোলা একটি সঞ্চয়ী হিসাব ব্যবহার করা হয়েছে ব্যবসায়িক বিনিয়োগে, যা নিয়মবিরুদ্ধ।
বিদেশে সম্পদ গড়ার অভিযোগ
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে সিঙ্গাপুর, দুবাই এবং যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি রয়েছে। সিঙ্গাপুরে দুটি বাড়ির তথ্য নিশ্চিত পাওয়া গেলেও অন্য দেশগুলোর বিষয়ে এখনও তদন্ত চলছে।
ব্যাংক হিসাব স্থগিত
অর্থ লেনদেনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর বিএফআইইউ ২০২৩ সালের ১ জুলাই শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে। পরবর্তীতে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই স্থগিতাদেশ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কার্যকর রয়েছে।
উপসংহার
এই ঘটনায় দেশের ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা ও নজরদারি ব্যবস্থার বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন ও বিদেশে সম্পদ গড়ার অভিযোগ শুধু আর্থিক খাত নয়, দেশের ভাবমূর্তির সঙ্গেও জড়িত। এখন দেখার বিষয়, তদন্ত শেষে এ অভিযোগ কতটা প্রমাণিত হয় এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নেয়।
আরও পড়ুন: আরও কমলো এলপি গ্যাসের দাম: ভোক্তাদের জন্য স্বস্তির খবর