বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে একটি বড় অভিযোগ ছিল—বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির প্রভাব। এতে অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়েছেন এবং অনেক অযোগ্য ব্যক্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক আনুগত্য বা আর্থিক লেনদেনের কারণে নিয়োগ পেয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই সমস্যার সমাধান করতে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএ) নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
কেন এ সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ?
আগে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির প্রভাব ছিল প্রবল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই প্রার্থীদের শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হতো। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, ঘুষ, রাজনৈতিক চাপে সিদ্ধান্ত বদলানোসহ নানা অসংগতি ছিল। ফলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এখন থেকে এনটিআরসিএ সরাসরি নিয়োগ প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করবে। যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচন করা হবে পরীক্ষার মাধ্যমে এবং সেখান থেকেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও অন্যান্য পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।
প্রস্তাবনা ও পদক্ষেপ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, শুধু প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষই নয়, বরং সহকারী প্রধান, সুপারিনটেনডেন্ট, সহকারী সুপার এবং অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগও এনটিআরসিএর মাধ্যমে হবে। এ জন্য আইন সংশোধন, নতুন ধারা সংযোজন এবং নিয়োগ পরীক্ষার নিয়ম প্রণয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাবিদদের মতামত
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে, এতদিন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে যোগ্য প্রার্থীরা উপেক্ষিত হয়েছেন। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক মহলের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা শিক্ষা মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তার মতে, এনটিআরসিএর হাতে নিয়োগ ক্ষমতা হস্তান্তর একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও এর সফলতা নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক চাপ প্রতিরোধের ওপর।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ বলেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রধান নিয়োগ নিশ্চিত হবে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের মান উন্নত হবে এবং শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা লাভ করবে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
যদিও সিদ্ধান্তটি প্রশংসনীয়, তবে এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
রাজনৈতিক চাপ পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যাবে কি না।
আইনগত জটিলতা ও প্রশাসনিক ধীরগতি।
এনটিআরসিএর পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেটের ঘাটতি।
সমাধানের প্রস্তাব
শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, এই উদ্যোগকে সফল করতে হলে কিছু অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে:
সম্পূর্ণ ডিজিটাল নিয়োগ ব্যবস্থা চালু করা।
অনলাইন আবেদন ও উন্মুক্ত মেধাতালিকা প্রকাশ করা।
স্বাধীন পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা।
এনটিআরসিএর সক্ষমতা ও বাজেট বাড়ানো।
জনগণের প্রতিক্রিয়া
অনেক শিক্ষক এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। রাজধানীর এক সহকারী অধ্যাপক বলেন, “স্বজনপ্রীতির কারণে নিয়োগ হলে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়। মেধাভিত্তিক নিয়োগই একমাত্র সমাধান।” তবে কেউ কেউ সতর্ক করে বলেছেন, এনটিআরসিএ যেন নতুন করে আরেকটি নিয়োগ বাণিজ্যের জায়গায় পরিণত না হয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে স্বচ্ছতা ও মান উন্নয়নের জন্য এনটিআরসিএর হাতে নিয়োগ ক্ষমতা দেওয়া একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। তবে এর কার্যকর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে সরকারের অঙ্গীকার, সঠিক তদারকি এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি ন্যায্য প্রক্রিয়ার ওপর। সঠিকভাবে এই ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষা খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আরও মানসম্মত শিক্ষা দিতে সহায়ক হবে।
আরও পড়ুন: সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন পে-স্কেল: সর্বশেষ অগ্রগতি ও সম্ভাবনা