রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে আবারও বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। নিজেকে একসময় ‘ইমাম মাহাদি’ দাবি করা নুরুল হক ওরফে নূরাল পাগলার মৃত্যুর পর তার কবর ও দরবারকে কেন্দ্র করে তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) জুমার নামাজের পরপরই তৌহিদি জনতা তার কবর থেকে মরদেহ তুলে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তার দরবার শরিফ, বাড়িঘর, এমনকি সরকারি গাড়িতেও হামলা চালানো হয়। ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ঘটনার পটভূমি
সম্প্রতি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুরুল হক মারা যান। মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত গোয়ালন্দ দরবার শরিফে কাবা শরিফের আদলে একটি উঁচু বেদি তৈরি করে সেখানে তাকে দাফন করা হয়। কবরের উচ্চতা প্রায় ১২ ফুট বলে অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়টি ঘিরেই স্থানীয় তৌহিদি জনতার মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা দাবি তোলে, কবর নিচু করে সাধারণ নিয়মে দাফন করা হোক এবং কবরের চারপাশে স্থাপিত বিশেষ চিহ্ন ও সাইনবোর্ড অপসারণ করা হোক।
শুক্রবারের সহিংসতা
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী জুমার নামাজের পর বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়ে প্রতিবাদ মিছিল শুরু করে। তারা প্রথমে গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লাপাড়ার শহীদ মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবে সমবেত হয়। সেখান থেকে বিক্ষোভকারীরা নূরাল পাগলার বাড়ি ও দরবার শরিফের দিকে অগ্রসর হয়। মুহূর্তের মধ্যেই দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ শুরু হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন আগেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও জনতার প্রচণ্ড চাপ সামলানো সম্ভব হয়নি। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের দুটি গাড়ি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িও ভাঙচুর করে। পরে সেনাবাহিনী ও র্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করে।
মরদেহ উত্তোলন ও অগ্নিসংযোগ
প্রথম দফার সহিংসতার পর কিছুটা শান্ত হলেও বিক্ষোভকারীরা পুনরায় নূরুল হকের বাড়িতে প্রবেশ করে। তখন তারা কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মা মোড়ে নিয়ে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ দৃশ্য দেখতে শত শত মানুষ জড়ো হয় এবং এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশাসনের বক্তব্য
গোয়ালন্দের ইউএনও নাহিদুর রহমান জানান, ঘটনাস্থলে সেনা ও র্যাব মোতায়েন রয়েছে। আহতের সঠিক সংখ্যা এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেছেন তিনি। রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম বলেন, “তৌহিদি জনতার একটি অংশ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে সরকারি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে তারা দরবারে অগ্নিসংযোগ করে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
অনেকেই অভিযোগ করেন, নূরাল পাগলা অতীতে নিজেকে শুধু ‘ইমাম মাহাদি’ নয়, বরং খোদা দাবি করেছিলেন। তার এসব কর্মকাণ্ড ইসলামবিরোধী হিসেবে ধরা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি বলেই এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে।
পরিবারের অবস্থান
অন্যদিকে, নূরুল হকের ছেলে মেহেদী নূর জিলানী গণমাধ্যমকে জানান, তার বাবা প্রকৃত অর্থে ইমাম মাহাদির দ্বীন প্রচারক ছিলেন। তিনি বলেন, “আমার বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী কিছুটা উঁচু করে কবর দেওয়া হয়েছে। এটি তিন থেকে চার ফুটের বেশি নয়। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে।”
উপসংহার
নূরাল পাগলার মৃত্যুর পর থেকে তার কবর ও দরবারকে ঘিরে চলমান উত্তেজনা অবশেষে ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নিল। জনতার ক্ষোভ, প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং ধর্মীয় আবেগ মিলিয়ে এই ঘটনাটি পুরো রাজবাড়ী জেলায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন থাকলেও পরিস্থিতি থমথমে।
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে এনটিআরসিএর হাতে নিয়োগ ক্ষমতা