বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত মামলাগুলোর একটি হলো গণ-অভ্যুত্থানকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। এ মামলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিয়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলাম। তিনি আদালতে জানিয়েছেন যে, ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে প্রশাসনের চাপের কারণে চারবার পরিবর্তন আনতে বাধ্য করা হয়েছিল তাকে।
আবু সাঈদের মৃত্যু ও প্রথম ময়নাতদন্ত
গত বছরের ১৬ই জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ বুক ও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে শটগানের পিলেটের আঘাত স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার পর ডা. রাজিবুল তার প্রথম প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।
কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তারা তার এই প্রতিবেদন গ্রহণ না করে পুনরায় রিপোর্ট দিতে বলেন। প্রথমে ভাষাগত পরিবর্তন আনতে বলা হয়, পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম মতামত দেওয়ার জন্যও চাপ সৃষ্টি করা হয়।
প্রশাসনিক চাপ ও প্রলোভন
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ডা. রাজিবুল জানান, এক পর্যায়ে তাকে রংপুর মেডিকেলের ভাইস-প্রিন্সিপালের কক্ষে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে চাপ সৃষ্টি করেন। সেখানে তাকে বলা হয়, “বুলেট ইনজুরি” পরিবর্তন করে “হেড ইনজুরি” উল্লেখ করতে। এমনকি বিদেশ ভ্রমণের প্রলোভন, মামলার ভয় দেখানো এবং দুই সপ্তাহের কক্সবাজার ভ্রমণের প্রস্তাবও দেওয়া হয়।
কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে নিজের নৈতিক অবস্থান থেকে তিনি সরতে রাজি হননি। পরিশেষে বিভিন্ন সংশোধনের পর চতুর্থ প্রতিবেদন জমা দিলেও, তিনি কখনোই মূল সত্যকে অস্বীকার করেননি যে আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
অন্যান্য সাক্ষীর জবানবন্দি
আদালতে এই মামলায় আরও কয়েকজন সাক্ষী জবানবন্দি দিয়েছেন।
ফরেনসিক বিভাগের অফিস সহকারী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, তদন্ত কর্মকর্তা তাদের অফিস থেকে ময়নাতদন্ত সংক্রান্ত বই জব্দ করেছিলেন।
সাংবাদিক শরীফুল ইসলাম তার সাক্ষ্যে বলেন, আন্দোলন চলাকালে কুষ্টিয়ায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। চিকিৎসার মাধ্যমে তার শরীর থেকে ৬২টি পিলেট বের করা হলেও এখনো শতাধিক পিলেট শরীরে রয়ে গেছে।
আদালতের কার্যক্রম
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে এই সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। একইসঙ্গে আরও কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এর মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক ও পুলিশের ডিআইজি মোল্যা নজরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, মেহেরপুরে এক জামায়াত নেতাকে হত্যার অভিযোগে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া গুমের মামলায় শেখ হাসিনা ও আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় আগামী ২৬শে অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
উপসংহার
ডা. রাজিবুল ইসলামের এই জবানবন্দি দেশের বিচার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রশাসনিক চাপ, ভয়ভীতি এবং প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও তিনি সত্য প্রকাশে অটল ছিলেন। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোতে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করতে সাক্ষীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।