বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশ আজ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। কিছু দেশে প্রাদুর্ভাব খুব বেশি আবার কিছু দেশে প্রাদুর্ভাব তুলনামূলকভাবে কম। তবে এখন পর্যন্ত প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
তবে ইন্টারনেটের সুবিধাজনক ব্যবহারের ফলে মানুষ কিছু অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর বা স্বাস্থ্য পরামর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ছে যা বাস্তবিক পক্ষে প্রয়োজনীয় নয়। এগুলো কোনো কোনো সময় ক্ষতির কারণও হতে পারে। এই বিষয়গুলো নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন ব্লগে ও ওয়েবসাইটে নানা তথ্য প্রকাশ হয়েছে। সানরাইজ৭১ এ আজ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
প্রথমেই বলা যায়, রসুনের কথা। রসুন আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। এটি আমরা তরকারিতে সাধারনত ব্যবহার করি। কিন্তু, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে অসংখ্য পোষ্ট দেয়া হয়েছে যে, ‘যদি রসুন খাওয়া যায় তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব’।
কিন্তু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যদিও রসুন একটি স্বাস্থ্যকর খাবার এবং এটাতে ‘এন্টিমাইক্রোবিয়াল’ নামক উপাদান আছে কিন্তু এমন কোনো তথ্য প্রমাণ নেই যে – রসুন নতুন করোনা ভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে।
এ ধরণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদিও ক্ষতির কারণ নয় তথাপি এর মাধ্যমে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা পরোক্ষভাবে হলেও থেকেই যায়, কেননা সম্প্রতি ‘চায়না মর্নিং পোষ্ট’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে, করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে একজন নারী প্রায় দেড় কেজি কাঁচা রসুন খেয়ে ফেলেছে।
জরডান সাথের নামক একজন ইউটিউবার যার রয়েছে বিভিন্ন প্লাটফর্মে হাজার হাজার অনুসারী তিনি সম্প্রতি দাবি করেছেন ‘একটা অলৌকিক খনিজ পদার্থ’ যাকে এমএমএস নামে ডাকা হয় সেটা ব্যবহার করে করোনা ভাইরাস একেবারে সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব।
আসলে এটাতে রয়েছে ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড যেটা মূলত ব্লিচিং এজেন্ট। জরডান সাথের এবং অন্যরা এই পদার্থকে অনেক আগেই প্রচার করেছেন যখন করোনা ভাইরাস ছড়ায়নি।
কিন্তু জানুয়ারী মাসে আবার তিনি টুইটারে এই টুইট করে বলেন যে, ‘ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড’ ক্যান্সারের কোষকেও ধ্বংস করতে পারে এবং এটার দ্বারাই করোনা ভাইরাসকে ধ্বংস করা সম্ভব।’
অপরদিকে, গত বছরে মার্কিন ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সতর্ক করে বলে যে, এমএমএস পান করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও এই বিষয়ে স্পষ্ট সতর্কতা জারি করেছে।
মূলত, কেউ যদি এই এমএমএস নিয়মিত পান করে তবে তার মাথা ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া এবং পানি শূন্যতার মতো লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে যেটা ‘এফডিএ’ সতর্ক করেছে। এই পদার্থটি যে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কিংবা কোনো অসুস্থ্যতার জন্য পথ্য হিসেবে ব্যবহার হতে পারে এমন কোনো গবেষণা ‘এফডিএ’র কাছে নেই।
আমরা সবাই মোটামুটি এই ব্যাপারটি এখন জানি যে, বেশি বেশি করে সাবান পানি দিয়ে হাত ধৌত করতে হবে। আবার হাত ধোয়ার জল যেটা দিয়ে তাৎক্ষণিক জীবাণু ধ্বংস করা যায় বলে আমরা জানি তা ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরী হয়েছে।
করোনা ভাইরাস মহামারীতে ইটালি নামক দেশের নামটি প্রায় সবাই শুনেছেন। সে দেশে যখন এই জেল ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরী হলো তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ সব ধরণের ভার্চুয়াল মাধ্যমে এই জেল কিভাবে ঘরে বানানো যায় সেটার রেসিপি দেয়া শুরু হলো।
কিন্তু এই রেসিপিগুলো মূলত করোনা ভাইরাস কে উদ্দেশ্য করে দেয়া হলেও বাস্তবে এগুলো সাধারণ জীবাণুর জন্য যা টেবিলের উপরে কিংবা ঘরের মেঝেতে থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, এগুলো ত্বকের জন্য কোনো ভাবেই উপযুক্ত নয়।
অ্যালকোহল যুক্ত হ্যান্ড জেলগুলোতে প্রায় ৬০%-৭০% অ্যালকোহল থাকে। এর সাথে থাকে এমোলিয়েন্ট নামক এক ধরণের পদার্থ যেটা ত্বককে নরম রাখতে সহায়তা করে। আসলে ঘরে বসে হাতের জন্য উপযুক্ত জীবাণুনাশক যে তৈরী করা সম্ভব নয় তা সম্প্রতি মানুষ জেনে গেছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানীও এই কথায় সায় দিয়েছেন।
এক প্রকার জল যেটাকে ‘কলোইডিয়াল সিলভার’ বলা হয়। এটাতে মূলত রুপার ক্ষুদ্র কণিকা মেশানো থাকে। মার্কিন একজন ধর্ম প্রচারক (জিম বেকার) এই জল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
তার অনুষ্ঠানের একজন অতিথি অহেতুক দাবি করে বসেন যে, এই জল কয়েক ধরণের করোনা ভাইরাস মেরে ফেলতে সক্ষম। অবশ্য পরে তারা স্বীকার করে যে, এই জল কোভিড-১৯ এর উপর পরীক্ষা করা হয়নি।
ঐ ধর্ম প্রচারকের সমর্থকেরা দাবি করে যে, এই জল অ্যান্টিসেপটিক এবং বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসায় ব্যবহার করা চলে। কিন্তু মার্কিন স্বাস্থ্য সমর্থকরা পরিষ্কার ভাবে বলে দিয়েছেন যে, এই ধরণের রুপা মিশ্রিত জল দিয়ে সাধারণত স্বাস্থ্যের কোনো উপকার হয় না।
এটা বেশি ব্যবহার করলে বরং কিডনীর ক্ষতি পারে এবং মানুষ জ্ঞান হারাতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, লোহা এবং জিংক মানব দেহের জন্য উপকারী হলেও রুপা তেমনটা নয়।
ফেইসবুকে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যে, করোনা ভাইরাস মুখের মধ্যে ঢুকে পড়লেও প্রতি ১৫ মিনিট পর পর পানি খেলে তা দেহ থেকে বের হয়ে যায়। একজন জাপানী ডাক্তারকে উদ্ধৃত করে এ কথা বলা হয়েছিল।
এই পোষ্টের একটি আরবি ভার্সন ফেইসবুকে মোট দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বার (২,৫০,০০০) বার শেয়ার করা হয়েছে। কিন্তু লন্ডনের স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক স্যালি ব্লুমফিল্ড বলেছেন যে, এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
এছাড়াও গরম পেলে নাকি এই করোনা ভাইরাস মারা যায় এমন ভুড়ি ভুড়ি পোষ্ট ফেইসবুকে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কেউ কেউ দিনের বেলায় কয়েক বার গরম পানি পান করছেন। কেউ আবার কক্ষের ভিতরে গরম থাকা স্বত্বেও ফ্যান চালু করছেন না।
গরম পানিতে গোসল করারও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ইউনিসেফের মতো প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি পোস্ট নানা দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরাঘুরি করছে। এতে বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গরম পানি পান করলে এবং রৌদ্রের মধ্যে থাকলে করোনা ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হবে। অন্যদিকে, ঠাণ্ডা খাবার খেতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বিশেষ করে আইসক্রীম।
কিন্তু ইউনিসেফ কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা পুরোপুরি ভুয়া একটি খবর। ফ্লু ভাইরাস মানব দেহের বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না। আর দেহের বাইরে এই জীবাণুকে মেরে ফেলতে হলে কমপক্ষে ৬০-৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লাগবে যা গোসলের পানি থেকে অনেক বেশি গরম।
কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, গরমে কিছু জীবাণু সত্যিই ধ্বংস হয়। তবে এর জন্য সাধারণ রোদের তাপমাত্রার মতো হলে চলবে না। আর করোনা ভাইরাস আসলে গরমে কি আচরণ দেখায় তা এখনও অজানা।
তথ্যসুত্রঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবসাইট।
আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করলাম। আশা করি, আপনারা বুঝতে পেরেছেন। ফিরে আসবো অন্য দিন নতুন কোনো পোস্ট নিয়ে। সবাই সুস্থ্য, সুন্দর ও ভালো থাকুন। নিজের প্রতি যত্নবান হউন এবং সাবধানে থাকুন।
এই পোস্টটি যদি আপনার ভালো লাগে এবং প্রয়োজনীয় মনে হয় তবে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন।
[বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যগুলো কেবল স্বাস্থ্য সেবা সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণের জন্য। অনুগ্রহ করে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করুন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনে আপনার শারিরীক বা মানসিক ক্ষতি হতে পারে। প্রয়োজনে, আমাদের সহযোগীতা নিন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।]
Leave a Reply