যে যাই বলুক না কেন, হোমিওপ্যাথি হচ্ছে সেরা চিকিৎসা বিজ্ঞান। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যারা অস্বীকার করেন তারা হোমিওপ্যাথির ‘হ’-ও বুঝে না। হোমিওপ্যাথিকে সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন চিকিৎসা বিজ্ঞান বলতে আজ কোনো বাঁধা নেই।
এই চিকিৎসা বিজ্ঞান আবিষ্কৃত হয় জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান কর্তৃক ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে। হোমিওপ্যাথির জনক ডাক্তার স্যামুয়েল হ্যানিম্যান প্রথমে একজন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন। তিনি জার্মানির মিশেনে স্যাকনি নগরে ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন।
এই মহাত্মার পুরো নাম ক্রিস্টিয়ান ফ্রেড্রিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। তিনি ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মরে গেছেন ঠিকই কিন্তু তার কর্ম চিরকাল রয়ে যাবে পৃথিবীতে।
আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, হ্যানিম্যান মাত্র ২২ বছরে বয়সে সর্বমোট ১১ টি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করতে সক্ষম হন। তিনি সাধারণত জার্মান, গ্রীক, ইংরেজী, ল্যাটিন, ইটালিয়ান, হিব্রু, সিরিয়াক, আরবী, স্প্যানিশ, চ্যালডেইক ও ফরাসী ভাষায় পড়তে ও লিখতে ও অনুবাদ করতে পারতেন।
হ্যানিম্যানের মোট ১১৬টি বৃহৎ গ্রন্থ ছিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় গ্রন্থ হলো – ফ্রাগমেন্ট দ্য ভিরিবাম যেটা ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত, অর্গানন অব মেডিসিন যেটা ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত, মেটিরিয়া মেডিকো পিউরো যেটা ১৮১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এবং ক্রণিক ডিজিজেস যেটা ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে।
হোমিওপ্যাথির জনক মহাত্মা হ্যানিম্যান তার জীবনের দীর্ঘ সময় জুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াবলী নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেছেন। তিনি বিভিন্ন ইতিহাস পর্যালোচনাও করেছেন।
পরিশেষে তিনি সিদ্ধান্তে এসেছেন এবং বলেছেন যে, ‘প্রচলিত এলোপ্যাথি চিকিৎসায় রোগের কেবলমাত্র সাময়িক উপশম হয় এবং এই চিকিৎসা প্রথার সাফল্যের সাথে কিছু বিষময় ফল বা প্রতিক্রিয়া অনতিবিলম্বে দেখা দেয়। আজ যে ওষুধ অমোঘ বলে ঘোষিত হলো দুদিন যেতে না যেতেই তা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে পরিত্যক্ত হয়’।
কোন কোনো ক্ষেত্রে এক রোগ চাপা পড়ে আরেক রোগ সৃষ্টি হয় এবং এ ধরণের কুফলের ফলে পৃথিবীতে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। আর এই বিষয়টি তৎকালীন সেই সময়েও খ্যাতিমান চিকিৎসকদের সত্যিকার অর্থেই ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
আর এই পরিস্থিতির ফলস্বরুপ মহাত্মা হ্যানিম্যান প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি (অ্যালোপ্যাথিক) পরিত্যাগ করেন এবং রোগে আক্রান্ত মানুষকে কিভাবে বিনা কষ্টে ও কম সময়ে কিভাবে আরোগ্য করে তোলা যায় তা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা শুরু করেন এবং নিজেকে উৎসর্গ করেন।
অবশেষে দীর্ঘদিন গবেষণার পর হ্যানিম্যান উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন – ‘রোগারোগ্যের শাশ্বত পথের সন্ধান আমি পেয়েছি। সেই পথ প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতার পথ। প্রকৃতির সঙ্গে বিরুদ্ধাচারণ করে নির্মল আরোগ্য বিধান সম্ভব নয়। আদর্শ আরোগ্য নিমিত্ত প্রকৃতি নির্দিষ্ট একটি মাত্র পথ আছে তা হলো Similia Similibus Curentur অর্থাৎ যে ভেষজ সুস্থ দেহে যে ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম সেই ধরনের রোগ সেই ভেষজ দ্বারাই আরোগ্য লাভ সম্ভব।’
হ্যানিম্যান এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির নামকরণ করেন – Homeopathy যাকে বাংলায় বলা যায় সদৃশ্য আরোগ্য বিধান পদ্ধতি।
১। সদৃশ নিয়মে চিকিৎসা অর্থাৎ সদৃশ দ্বারা সদৃশ আরোগ্য।
২। সুস্থ্য মানবদেহের ওপর বিশেষভাবে পরীক্ষিত ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করা।
৩। অনেক ক্ষেত্রে শক্তিকৃত ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করা।
৪। রোগীর সমস্ত লক্ষণের সাথে সদৃশ লক্ষণের ভিত্তিতে ওষুধ প্রয়োগ করা।
৫। অবশ্যই প্রতিবার একটি মাত্র ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করা।
৬। প্রত্যেক সময় রোগীকে পরিবর্তিত মাত্রায় ওষুধ দেয়া।
৭। মূলত হোমিওপ্যাথিতে রোগের নয় – রোগীর চিকিৎসা করা হয়। আর রোগীর আংশিক চিকিৎসা করা হয় না, সামগ্রিক চিকিৎসাই করা হয়।
৮। বিভিন্ন ধরণের Plants, Animals, Minerals, Nosodes, Sarcodes এবং Imponderabalis উৎসসমুহ থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা হয় এবং এসব ওষুধের সাহায্যেই বিভিন্ন রোগীর চিকিৎসা করা হয়।
আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে, মহাত্মা হ্যানিম্যান যখন বেঁচে ছিলেন তখন থেকেই হোমিওপ্যাথির প্রচার ও প্রসার হতে থাকে। কিছু মানুষ যদিও এর বিরোধিতা করছিল কিন্তু তারা টিকে থাকতে পারেনি।
প্রথমদিকে জার্মানী, এর পরে যে দেশগুলোর নাম আসে তা হলো ফ্রান্স, বৃটেন, আমেরিকা এবং রাশিয়া। আস্তে আস্তে ভারতবর্ষের দিকেও এর প্রচার ও প্রসার ঘটতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে এর বিস্তৃতি খুব দ্রুত ঘটে।
আপনি জেনে অবাক হবেন যে, বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৮০টি দেশে খুব সুচারুরূপে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে মানুষ পরিচিত। এই সব দেশে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল।
আরও একটি বড় কথা হচ্ছে, তৎকালীন ইউরোপের অনেক রাজা-রানী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কার্যকারিতা বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাই তারা হোমিওপ্যাথিক বিভিন্ন চিকিৎসকদের ‘রাজ চিকিৎসক’ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
এর ফলে বৃটিশ রাজ-পরিবারে হোমিওপ্যাথির জনপ্রিয়তা খুব বেশি বেড়ে যায়। যেকোন সমস্যায় তারা হোমিওপ্যাথির উপরই নির্ভর করতেন। ১৯২৫ সালে বৃটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক’কে রাজ চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করেন।
অপরদিকে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক’কে ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেন। বর্তমান সময়ে বৃটেনে মোট ছয়টি সরকারি হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল খুব সুচারুরূপে এবং সম্মানের সাথে চালু রয়েছে। আর আমেরিকায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয় ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।
বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছে বিশ্বের নাম করা শীর্ষস্থানীয় হোমিও ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পাণী যার নাম হলো – ‘বোরিক এণ্ড টাফেল কোম্পাণী’। আর ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব জায়গায় আস্তে আস্তে হোমিওপ্যাথি জায়গা দখল করে নেয় এর ভালো ফলাফলের কারণে।
আর বর্তমানে ভারতে এই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে, পাশ্চাত্যের দেশ গ্রীসে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে হোমিওপ্যাথিক শিক্ষা ও চিকিৎসা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে সাড়া জাগানো চিকিৎসক ডা. জর্জ ভিথোলকাসের বাড়িও গ্রীসে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য সুইডিস পার্লামেন্ট থেকে ১৯৯৬ সালে তাকে Right Livelyhood Award (Alternative Noble Prize) এ ভূষিত করে। এই প্রশংসিত ডাক্তারের মতে, রোগের প্রথম অবস্থায় যদি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণ করা হয় তবে ৭০-৮০% রোগই নিরাময় করা সম্ভব।
আরও কয়েকজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার যেমন – ডা. ডাজেন, ডা. এডি লিপি, ডা. জেটিকেন্ট, ডা. ক্লার্ক, ডা. বেকিং, ডা. জেএন কাঞ্জিলাল, ডা. কেএন মাথুর সহ আরও অনেকেই রয়েছেন। এরা বৈশ্বিকভাবে নামকরা ডাক্তার খুবই সম্মানিত।
বিশ্বের মধ্যে অগণিত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি ও গবেষকগণ হোমিওপ্যাথিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শুধু দুই একজন ব্লগার স্বীকৃতি দেয়নি। অবশ্য এরা কোনো সময় দেবেও না। এদের কাজই হচ্ছে হোমিওপ্যাথির গীবত গাওয়া। এরা অবশ্য খুবই নগণ্য। এদের ঐরকম লেখালেখিতে হোমিওপ্যাথির কিচ্ছু যায় আসে না।
ইংল্যান্ডের ডক্টর ইউলিয়াম বয়েড ইমানুমিটার যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখেন যে, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ থেকে বিদ্যুৎ চুম্বক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। অপরদিকে, জর্জ বার্নাড-শ তার এক নাটকের ভূমিকায় বলেন যে, ‘হোমিওপ্যাথি ওষুধ বর্ণিতভাবে কাজ করে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না’।
এছাড়াও বালিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশ্বের অন্যতম সার্জন বায়োলজির গবেষক হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তার নিজের উপর ও তার সহকারীর উপর প্রয়োগ করেন এবং ফলাফলস্বরুপ লিখেন যে, ‘এক সময় আমার অভিযোগ ছিল হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানবর্জিত ও ফাঁকিবাজি।
আসলে হ্যানিম্যান আমার থেকে এক শতাব্দী এগিয়ে থাকায় হোমিওপ্যাথি বুঝতে আমার সময় লেগেছে’। ফ্রান্সের একদল গবেষক তিনটি উন্নত দেশের ১৪ জন বিজ্ঞানীর প্রতিনিধি দল নিয়ে একটি গবেষণা করেন প্রায় ৩ বছর। পরিশেষে তারা রিপোর্ট দেন যে, ‘হোমিওপ্যাথি ওষুধের কার্যকারিতা নিঃসন্দেহ এবং শক্তিকরণ পদ্ধতি বিজ্ঞানভিত্তিক’।
আমরা অত দূরে যাচ্ছি না, আমাদের চারপাশেই তাকান – তাকালে দেখবেন যে, অসংখ্য মানুষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য সুন্দর জীবন-যাপন করছেন। তাদেরকে কেউ যদি সারাদিন বুঝায় যে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অপবিজ্ঞান – এটাতে কাজ হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনো লাভ কিন্তু হবে না।
কারণ, যিনি উপকৃত হয়েছেন তিনিই জানেন হোমিওপ্যাথির মাহাত্ম। একটু আগে কিছু ব্লগারের কথা বলেছি। তাদের ঐ লিখাগুলোর নিচে যারা কমেন্ট করেছেন তাদের লিখাগুলো সময় হলে পড়ে আসবেন। সেখানে, স্পষ্টভাবে অনেকেই কমেন্ট করেছেন যে, হোমিওপ্যাথি অপবিজ্ঞান হোক আর কি বিজ্ঞান হবে হোক – আমি এটাতে উপকার পেয়েছি এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।
আরেকটি ব্যাপার হলো- টিউমার, আঁচিল, লিউকোরিয়া সহ আরও কিছু রোগে অ্যালোপ্যাথিতে তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে এর খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সুতরাং কথা আর বাড়াচ্ছি না। হোমিওপ্যাথিকে বুঝতে হলে এটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।
এর চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। হোমিওপ্যাথির বৈশ্বিক অবস্থান দেখতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, হোমিওপ্যাথি যখন থেকে শুরু হয়েছে তখন থেকে আজ পর্যন্ত এটা বিশ্বের মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরুপ এবং চিরকাল আশীর্বাদস্বরুপই থাকবে।
[বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যগুলো কেবল স্বাস্থ্য সেবা সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণের জন্য। অনুগ্রহ করে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করুন। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবনে আপনার শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হতে পারে। প্রয়োজনে, আমাদের সহযোগিতা নিন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।]
Leave a Reply