নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় এক মর্মস্পর্শী ঘটনায় স্থানীয় সম্প্রদায় হতবাক। একটি মাদ্রাসায় পড়ুয়া মাত্র ৯ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তবে থানায় অভিযোগ না করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে সালিশের নামে যা ঘটেছে, তা ন্যায়বিচারের পরিবর্তে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ
ভুক্তভোগী শিশুটি স্থানীয় খুরশিদিয়া নুরানী ইসলামিয়া মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা বিদেশে থাকেন, ফলে পরিবারটি আর্থিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল। অভিযুক্ত হেলাল উদ্দিন একই এলাকার বাসিন্দা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হেলাল উদ্দিন তার নাতনিকে মাদ্রাসা থেকে নিতে গিয়ে শিশুটিকে একা পেয়ে তাকে ২০ টাকা দেন। এরপর তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে মেয়েটি চিৎকার করে বাড়ি ফিরে আসে এবং মাকে ঘটনাটি জানায়। পরিবারটি প্রথমে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে চাইলে স্থানীয় বিএনপি নেতা আব্দুর রহমান খোকন ও তার অনুসারীরা তাদের থামান। পরিবর্তে, তারা একটি সালিশের আয়োজন করে।
সালিশের নামে ইনসাফ হত্যা
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) বিকেলে চরবাটা ইউনিয়নের খাসেরহাট বাজারে এই সালিশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অভিযুক্ত হেলাল উদ্দিনকে ১০ বেত্রাঘাত ও চড়-থাপ্পড় দেওয়া হয় এবং ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টি ‘মিটমাট’ করা হয়।
সালিশে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বিএনপি নেতা, জামায়াতের নেতা, মাদ্রাসা শিক্ষক ও ইমামগণ। তবে সালিশের এই সিদ্ধান্ত ন্যায়বিচারের পরিবর্তে একটি ভয়াবহ অপরাধকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
অভিযুক্তের বক্তব্য: অস্বীকার ও পাল্টা অভিযোগ
অভিযুক্ত হেলাল উদ্দিন ঘটনাটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, “আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ, তাই চিকিৎসার জন্য নোয়াখালীর বাইরে আছি। বিএনপি নেতা খোকন নিজে থেকে এই সালিশ করেছে, যা অগ্রহণযোগ্য।”
তার স্ত্রী জোবায়দা বেগমও স্বামীর পক্ষে কথা বলেন এবং দাবি করেন, “তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়েছে। তিনি যদি দোষী হতেন, তাহলে সমাজ তাকে শাস্তি দিত, কিন্তু এভাবে মারধর করা অন্যায়।”
বিএনপি নেতার অস্বীকার
খাসেরহাট বাজারের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ও ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি মো. আব্দুর রহমান খোকন সালিশের ঘটনা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, “এমন কোনো সালিশ আমাদের এলাকায় হয়নি এবং এমন ঘটনাও ঘটেনি।”
সমাজে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ
ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—
-
কেন থানায় অভিযোগ না করে সালিশের পথ বেছে নেওয়া হলো?
-
একটি ধর্ষণের চেষ্টার মতো জঘন্য অপরাধ কীভাবে টাকার বিনিময়ে মিটমাট হতে পারে?
-
প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপ কি আইনের শাসনকে ব্যাহত করছে?
আইনের শাসন নিশ্চিত করা জরুরি
শিশু ধর্ষণের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি শুধু অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয় না, বরং ভবিষ্যতে এমন অপরাধকে উৎসাহিত করে।
-
পুলিশ ও প্রশাসনের উচিত ঘটনাটি তদন্ত করে দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
-
সালিশের নামে ন্যায়বিচার হরণের মতো ঘটনা বন্ধ করতে স্থানীয় নেতাদের ভূমিকা পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
-
শিশু সুরক্ষা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সমাপ্তি: ন্যায়বিচার চাই
একটি শিশুর নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সর্বাগ্রে। সালিশের নামে অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আশা করা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন এবং ভুক্তভোগী পরিবারকে সুরক্ষা দেবেন।
আরও পড়ুন: ১২ বছরের মেয়েকে কৌশলে হোটেলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা
#শিশু_সুরক্ষা #ন্যায়বিচার_চাই #সালিশ_নয়_আইনের_শাসন