ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে দেশের ছাত্রসমাজে যেমন উৎসাহ রয়েছে, তেমনি নানা গুজবও ছড়িয়েছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্পষ্টভাবে জানিয়েছে—এই নির্বাচনে তাদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক অবস্থান
৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ডাকসু নির্বাচনে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই এবং এ ধরনের গুজব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর আগে আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেও বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছিল।
তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, একটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সেনাবাহিনীর নাম জড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করছে, যা শিক্ষাঙ্গনের স্থিতিশীল পরিবেশ নষ্টের অপচেষ্টা। সেনাবাহিনী আশা প্রকাশ করেছে—দীর্ঘদিন পর আয়োজিত এই কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে এবং এটি জাতীয় রাজনীতির জন্যও একটি ইতিবাচক উদাহরণ হয়ে উঠবে।
ভোট গ্রহণ ও ফল প্রকাশের প্রস্তুতি
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা সরাসরি এলইডি স্ক্রিনে প্রদর্শন করা হবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে স্ক্রিন বসানো হয়েছে যাতে শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে ফলাফল দেখতে পারেন।
আজ মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী ডাকসুর ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে নারী প্রার্থী আছেন ৬২ জন। প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন।
ভোট গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোট আটটি কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিটি হলে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে ভোট দিচ্ছেন। যেমন—কার্জন হলে কয়েকটি আবাসিক হলের ভোট অনুষ্ঠিত হয়, অন্যদিকে টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব, সিনেট ভবন, উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন স্থানে ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ভোট শেষে ফলাফলের অপেক্ষা
বিকেল ৪টায় ভোট গ্রহণ শেষ হলেও, কেন্দ্রের ভেতরে লাইনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে পেরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান দাবি করেছেন, এবারকার ভোটগ্রহণ ছিল স্বচ্ছ এবং শান্তিপূর্ণ। তাঁর ভাষায়, “ইতিমধ্যে বিভিন্ন কেন্দ্রে ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে, যা ছাত্রসমাজের অংশগ্রহণকে প্রমাণ করে।”
যদিও অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল, তবে কিছু প্রার্থী অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন—ব্যালটে আগেভাগে চিহ্ন দেওয়া, পোলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়া কিংবা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে প্রার্থীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা হয়েছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
নির্বাচন ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধান প্রবেশপথে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয় এবং টিএসসি এলাকায় পুলিশের বিশেষ নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়। পাশাপাশি বিজিবি সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেছেন যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি না হয়।
ডাকসুতে এবার মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ১৮ হাজার ৯৫৯ জন এবং ছাত্র ভোটার সংখ্যা ২০ হাজার ৯১৫ জন। ডাকসুর ২৮টি কেন্দ্রীয় পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী, আর ১৮টি হলে মোট ২৩৪টি পদে প্রার্থী হয়েছেন ১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী।
সাংবাদিকের মৃত্যুতে শোক
নির্বাচন কভার করতে গিয়ে দুঃখজনকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন সাংবাদিক তরিকুল ইসলাম। কার্জন হলে দায়িত্ব পালনকালে তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই ঘটনা নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের গভীরভাবে শোকাহত করেছে।
উপসংহার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন সবসময়ই দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এবারও শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে তারা গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতি আন্তরিক। সেনাবাহিনীর স্পষ্ট বক্তব্যে পরিষ্কার—এই নির্বাচনে কোনো বাহিনীর হস্তক্ষেপ নেই। এখন শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হবে এবং নতুন নেতৃত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করবে।
আরও পড়ুন: কেরানীগঞ্জে মায়ের হাতে দুই বছরের শিশুহত্যা: মানসিক ভারসাম্যহীনতা নাকি পারিবারিক দ্বন্দ্বের ফল?