ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে বুধবার সকালে ডাকসুর নির্বাচনী কমিশন চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করে। এবারের নির্বাচনে ভিপি, জিএস ও এজিএস—এই তিন শীর্ষ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আলোচিত কয়েকজন প্রার্থী। ঘোষিত ফলাফলে কে কত ভোট পেলেন, সেটিই এখন শিক্ষার্থীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
সহসভাপতি (ভিপি) পদ
ভিপি পদে এবারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বেশ জমজমাট। ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়—
আবু সাদিক কায়েম (ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, ছাত্রশিবির-সমর্থিত) পেয়েছেন ১৪,০৪২ ভোট
আবিদুল ইসলাম খান (ছাত্রদল সমর্থিত) পেয়েছেন ৫,৭০৮ ভোট
শামীম হোসেন (স্বতন্ত্র) পেয়েছেন ৩,৮৮৩ ভোট
উমামা ফাতেমা (স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল) পেয়েছেন ৩,৩৮৯ ভোট
আবদুল কাদের (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ) পেয়েছেন ১,১০৩ ভোট
শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি (প্রতিরোধ পর্ষদ) পেয়েছেন ৬৮ ভোট
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, আবু সাদিক কায়েম বিপুল ভোটে এগিয়ে থেকে সহসভাপতি পদে জয়ী হয়েছেন।
সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদ
জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে। ভোটের হিসাবে—
এস এম ফরহাদ (ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, ছাত্রশিবির-সমর্থিত) পেয়েছেন ১০,৭৯৪ ভোট
শেখ তানভীর বারী হামিম (ছাত্রদল সমর্থিত) পেয়েছেন ৫,২৮৩ ভোট
মেঘমল্লার বসু (প্রতিরোধ পর্ষদ) পেয়েছেন ৪,৯৪৯ ভোট
আরাফাত চৌধুরী (স্বতন্ত্র) পেয়েছেন ৪,০৪৪ ভোট
আবু বাকের মজুমদার (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ) পেয়েছেন ২,১৩১ ভোট
এখানে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী এস এম ফরহাদ একেবারে নির্দ্বিধায় জয় পেয়েছেন।
সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদ
এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও বৈচিত্র্যময় ছিল। ভোটের ফলাফলে পাওয়া যায়—
মুহা. মহিউদ্দীন খান (ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, ছাত্রশিবির-সমর্থিত) পেয়েছেন ১১,৭৭২ ভোট
তানভীর আল হাদী মায়েদ (ছাত্রদল সমর্থিত) পেয়েছেন ৫,০৬৪ ভোট
তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী (স্বতন্ত্র) পেয়েছেন ৩,০০৮ ভোট
জাবির আহমেদ জুবেল (প্রতিরোধ পর্ষদ) পেয়েছেন ১,৫১১ ভোট
মহিউদ্দিন রনি (স্বতন্ত্র) পেয়েছেন ১,১৩৭ ভোট
আশরেফা খাতুন (বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ) পেয়েছেন ৯০০ ভোট
আশিকুর রহমান জীম (স্বতন্ত্র) পেয়েছেন ৭৯৬ ভোট
হাসিবুল ইসলাম (স্বতন্ত্র) পেয়েছেন ৫০০ ভোট
এখানেও ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী মহিউদ্দীন খান বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন।
সদস্য পদে জয়-পরাজয়ের চিত্র
ডাকসুর মোট ১৩টি সদস্য পদের মধ্যে ১১টিতে জয় পেয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। একটি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং অপরটিতে জয়ী হয়েছেন বামপন্থী প্রার্থী।
ছাত্রশিবির সমর্থিত বিজয়ীরা:
সাবিকুন নাহার তামান্না (১০০৮৪), সর্ব মিত্র চাকমা (৮৯৮৮), আফসানা আক্তার (৫৭৪৭), রায়হান উদ্দীন (৫০৮২), তাজিনুর রহমান (৫৬৯০), ইমরান হোসাইন (৬২৫৬), মিফতাহুল হোসাইন আল-মারুফ (৫০১৫), মো. রাইসুল ইসলাম (৪৫৩৫), শাহীনুর রহমান (৪৩৯০), আনাস ইবনে মুনির (৫০১৫), মো. বেলাল হোসেন অপু (৪৮৬৫)।
বামপন্থী প্যানেল থেকে জয়ী:
হেমা চাকমা (৪৯০৮) — প্রতিরোধ পর্ষদ।
স্বতন্ত্র প্রার্থী থেকে জয়ী:
উম্মা উসওয়াতুন রাফিয়া (৪২০৯)।
শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রতিশ্রুতি
ভিপি পদে জয়ী আবু সাদিক কায়েম নির্বাচনের পর প্রতিক্রিয়ায় বলেন,
“শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা মতভেদ ভুলে সবাই মিলে ক্যাম্পাসকে স্বপ্নের ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তুলব।”
তিনি আরও জানান, একসাথে কাজ করার জন্য প্রতিটি প্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট সংগঠন তাঁর কাছে উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হবেন।
ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রক্রিয়া
ভোটগ্রহণ হয় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি কেন্দ্রে ৮১০টি বুথে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
মোট ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৯,৮৭৪ জন।
ডাকসুর ২৮টি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ৪৭১ জন প্রার্থী।
এছাড়া ১৮টি হলে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রতিটি হলে ১৩টি করে মোট ২৩৪টি পদে ১,০৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্ক ও অভিযোগ
যদিও ফলাফল ঘোষণার পর অনেকেই তা স্বাগত জানিয়েছেন, তবে কিছু প্রার্থী নির্বাচনকে ‘কারচুপি হয়েছে’ বলে অভিযোগ তোলেন। ছাত্রদল-সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ও স্বতন্ত্র প্যানেলের উমামা ফাতেমা ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। একইসাথে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী আবদুল কাদেরও নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
উপসংহার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এবারের ফলাফলও সেই ধারাবাহিকতাকে স্পষ্ট করেছে। জয়-পরাজয়ের বাইরে শিক্ষার্থীরা চাইছেন একটি শান্তিপূর্ণ, সবার জন্য উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ। নির্বাচিতরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে যদি সত্যিই শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করেন, তবে এই নির্বাচন ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনবে।
আরও পড়ুন: ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত | ডাকসু নির্বাচন ২০২৫