অনুগ্রহ করে খুব মনোযোগ সহকারে পড়বেন। পুরো বিষয়টি না পড়ে কোন মন্তব্য করবেন না। এখানে কারও পক্ষ নিয়ে কথা বলা হয়নি। শুধুমাত্র যৌক্তিক আলোচনা করা হয়েছে।
আমার বাবা চাকরিজীবী। আমার মা গৃহিণী। মা বাবার ওপর নির্ভরশীল। একদম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রয়োজনে বাবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। আমি আমার স্বামীর ওপর এমন নির্ভরশীল হতে চাই না। তাই আমি চাকরি করব।
এই অনুচ্ছেদটি এদেশের অনেক পরিবারের চিত্র। একটু খেয়াল করুন, ‘নির্ভরশীল’ শব্দটিকে। এই শব্দটি পরিবারের মেয়েটির মধ্যে চাকরি করার স্পিরিট যোগিয়েছে। কিন্তু এই ভাবনাটি কি আসলেই যথার্থ? তার মা কি আসলেই তার বাবার ওপর নির্ভরশীল?
দেখুন, নির্ভরশীলতা তখন আসে যখন সেখানে বিনিময় থাকে না। যেমন, আমরা সূর্যের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা প্রয়োজনীয়, সারভাইভালের জন্য। বিনিময়ে আমরা সূর্যকে কিছু দিই না। তাই, আমরা সূর্যের ওপর নির্ভরশীল কথাটা যথাযথ।
এখন দেখুন, এই পরিবারটির ক্ষেত্রে কী হচ্ছে। অর্থ উপার্জন বাবা করছে, এটা সঠিক। কিন্তু মা কী করছে দেখুন: রান্নাবান্না, ঘর-দোর সুন্দর রাখা, বাচ্চাদের সুন্দর বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করা, স্বামীর শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণ করা—আরও কত কিছু!
এই কাজগুলো যদি তিনি না করতেন, তবে কি এই পুরুষ চলতে পারতেন? তাহলে দেখা গেলো, এই পুরুষও এই নারীর ওপর নির্ভরশীল। এবং, এই পুরুষেরই নারীটির ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। তবে একতরফাভাবে মেয়েটি কেন ভাবলো যে তার মা তার বাবার ওপর নির্ভরশীল?
চিন্তার মানদণ্ডের কারণে। মেয়েটি অর্থকে মানদণ্ড বানিয়েছে। অর্থ দিয়ে যা মাপা যায়, তার মূল্য আছে; অর্থ দিয়ে যা মাপা যায় না, তার মূল্য নেই।
কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, মায়ের কাজগুলোরও অর্থমূল্য আছে। যদিও অর্থমূল্য নির্ধারণ করা অযৌক্তিক, কারণ মা হচ্ছেন মা। তবে তর্কের খাতিরে আমরা একটুখানি হিসাব করি।
আপনি হোটেলে একবেলা খাবার খান। মা যে খাবার রান্না করেছেন, সেটা ভালো ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশনায় খেতে হলে হোটেলে ১০০ টাকার কাছাকাছি খরচ হতো।
হোটেলের বাবুর্চির স্যালারি কত? ১০ হাজার? কিন্তু আপনার মা তো ৩০ দিনে ৯০ বেলা ক্লান্তিহীন রান্না করছেন, আপনাকে ডেকে খাওয়াচ্ছেন, খাবার শেষে ধোয়া-টোয়ারা কাজও করছেন। তাহলে তাকে কত স্যালারি দেবেন?
ঝাড় দেয়া, ঘর মোছার জন্য একটি বুয়া রাখেন তো। দেখবেন, সে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করবে। কিন্তু খাটের নিচে ময়লা থেকে যাবে, শোকেজের কোণায় ধুলো জমে থাকবে। কিন্তু মা কত যত্ন নিয়ে ঘর ঝেড়ে মুছে রাখছেন। তাহলে মা-কে কত স্যালারি দেবেন?
প্রাইভেট টিউটরকে মাসে কত টাকা দেন? ৬-৭ হাজার? যে মা কথা বলা শেখাল, ভালো-খারাপ চেনাল, খাবার খেতে, ওয়াশরুমে যেতে, হাঁটতে, পড়তে, লিখতে শেখাল, তার কত স্যালারি হবে?
হাসপাতালের নার্স বা ডাক্তারকে কত টাকা দিলে তারা সারারাত আপনার শিয়রে বসে খেয়াল রাখবে, মায়ের মতো?
এরপর এই নারী স্বামীর হক আদায় করছে—শারীরিক হক আদায় করছে, মানসিক প্রশান্তি দিচ্ছে, দুঃশ্চিন্তা দূর করার চেষ্টা করছে।
সমস্যা শুনছে, সাজেশন দিচ্ছে, পুরো ফ্যামিলিকে মায়া দিয়ে আগলে রাখছে। মায়া তো এবস্ট্রাক্ট জিনিস, এটার অর্থমূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
তাহলে মায়ের কাজের অর্থমূল্য নেই, এমন বলা কি সঠিক? একেবারেই নয়। অর্থাৎ, “আমার বাবা চাকরি করছে, তাই আমার মা তার ওপর নির্ভরশীল” কথাটি সম্পূর্ণ অবান্তর। বাবা অর্থ সরবরাহ করছেন, এটি তার অধিকার, যা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন। এতে নারীর লজ্জার কিছু নেই।
তবে আলোচনা এখানেই শেষ নয়। আরেকটি অনুচ্ছেদে চলুন।
“আমার বাবা চাকরিজীবী। আমার মা গৃহিণী। মা বাবার ওপর নির্ভরশীল। বাবা মাকে যেভাবে-তেভাবে ট্রিট করেন, খোঁটা দিয়ে কথা বলেন, মতামতের মূল্য দেন না। আমি আমার স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে এসব সহ্য করতে চাই না। তাই আমি চাকরি করব।”
দেখুন, গল্পটা একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। এবার সমস্যাটা আর চিন্তার মানদণ্ডে নয়, বরং পুরুষের অবদানের কারণে। এই বাবা তার মেয়ের মধ্যে পুরুষ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি করেছেন, যা তাকে আল্লাহর তৈরি ফিতরাতের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করছে।
আমাদের সমাজের পুরুষদের একটি বড় অংশ প্রথম অনুচ্ছেদের মেয়েটির মতো চিন্তা করে। তারা ভাবেন, মেয়েরা চাকরি না করলে তারা আমাদের ওপর নির্ভরশীল, তাই তাদের যাচ্ছেতাইভাবে ট্রিট করা যাবে। দুই পক্ষই আল্লাহর দেওয়া ফিতরাতকে অস্বীকার করছে।
ইসলামী রাষ্ট্রে এসব সমাধানের ব্যবস্থা আছে। খলিফার আদালতে বিচার তোলা যায়, পুরুষটাকে সোজা করা যায়, সিরিয়াস কেসে তা-লা-ক পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান সমাজে? খলিফাও নেই, ইসলামী আদালতও নেই। গ্রামীণ বিচার বা শালিশে মহিলা বাই ডিফল্ট অপরাধী।
ঠিক সেই জায়গাতেই একটি চাকরিপ্রিয় ক্যারিয়ারিস্ট নারীর প্রজন্ম গড়ে উঠছে। তারা হয় প্রথম কেইসের, নয়তো দ্বিতীয় কেইসের। প্রথম কেইস হলে চিন্তার দৈন্যতা, দ্বিতীয় হলে পরিস্থিতির স্বীকার।
আমি সমাধান আলোচনা করব না। আমি শুধু দুটো কেইসের ফলাফল দেখাতে চাই।
নারী চাকরিতে আসলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা আসলে বিবিধ।
প্রথমত, ফিতরাত নষ্ট হওয়ার বিষয়টি। এই পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব জায়গা আছে, প্রতিটি প্রজাতির নিজস্ব অবস্থান আছে। ব্যতিক্রম নয় পুরুষ ও নারী। তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্নতাও সুন্দরভাবে এমনভাবে করা হয়েছে যাতে তারা পরস্পরের জন্য উপকারী হয়।
নারী ও পুরুষ কোথায় অবস্থান করবে, কী কার্য করবে—এটি নির্ধারণ করেছেন তাদের স্রষ্টা। ইসলাম অনুযায়ী, নারীর চাকরিতে অংশগ্রহণে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।
উদাহরণ:
যথাযথ পর্দা।
মাহরামসহ সফর।
খুব বেশি প্রয়োজন ব্যতীত নন-মাহরামের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন এড়িয়ে চলা।
স্বামীর হক আদায় করা।
সন্তানের হক আদায় করা।
বর্তমান সমাজে এইসব পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব। যেমন, যথাযথ পর্দা—আপনার অফিসে সম্ভব নয়। মাহরামসহ সফর—অফিস দূরে। নন-মাহরামদের সাথে ইন্টারঅ্যাকশন—অফিসে সবাই নন-মাহরাম।
দুটোই ভিন্ন চাপের ধরণ। সারাদিন অফিসের ক্লান্তি শেষে স্বামীর সঙ্গে সময় দেওয়া কঠিন। সন্তানের দায়িত্বও মায়ের অফিসের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে।
এইসব আলোচনা আমাদের তৃতীয় পরিবারের প্রতিচ্ছবি দেখায়।
“আমার বাবা-মা দুজনই চাকরিজীবী। দুজনে দিনভর অফিসে থাকেন। রাতে আসেন। এসে যান্ত্রিকভাবে আমার খোঁজ নেন। ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করেন। তারপর একদফা ঝগড়া করেন। বাবা-মা দুজনে রাতেও পরবর্তী দিনের অফিসের কাজ দেখেন। আমি সারাদিন একা ঘরে থাকি। হাসিনা খালা দুপুরে খাওয়ান। আমি টিভি দেখি, বাবা-মায়ের অপেক্ষা করি। আমার খুব কান্না হয়। আমি কাঁদলে খালা আমাকে বকা দেন।”
আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না। দুটি সিনারিও থেকে একটি ফলাফল দেখানো হলো।
ফেমিনিস্টদের প্রস্তাবিত সমাধান ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বাস্তবে প্রায় অসম্ভব।
পুরুষদের করণীয়: আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। স্ত্রীর মতামতের মূল্য দেওয়া। যাচ্ছেতাই ট্রিট না করা। স্ত্রীর নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করা।
বোনেদের প্রতি আহ্বান: সচেতন হোন। নারী হিসেবে নিজেকে চিনুন। নারীত্ব ভালোবাসুন ও সম্মান করুন। নিজের মর্যাদা রক্ষা করুন। ফেমিনিস্ট-দের চক্করে জীবন দুর্বিষহ করবেন না। পুরুষ আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, সহযোগী।