মানুষের চরিত্রকে যাচাই করার অন্যতম প্রধান উপায় হলো তার ভাষা। একজন মানুষ কেমন ব্যবহার করেন, কীভাবে কথা বলেন—এসবই তার অন্তরের প্রতিফলন। তিক্ত, কঠোর কিংবা আঘাতমূলক ভাষা কখনোই সুস্থ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না; বরং তা মানুষের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে। বিপরীতে, কোমল ও সুন্দরভাবে বলা কথা শুধু অন্যের মন জয় করে না, বরং একজন মানুষের উন্নত আখলাক ও মহৎ চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়।
ভাষা: চরিত্রের আয়না
ভাষা মানুষের ব্যক্তিত্বের আয়না। নবী-রাসূলগণ তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন মূলত সুন্দর ভাষা ও উত্তম আচরণের মাধ্যমে। আবার অন্যদিকে, ভাষার অপব্যবহারই মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে নেতিবাচক কথা, নিন্দা, অপবাদ এবং কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। এতে শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সমাজেও তৈরি হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়।
জ্ঞানের প্রকাশ ভাষার মাধ্যমে
যে কোনো জ্ঞান বা প্রজ্ঞার সঠিক প্রকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। চরিত্র দৃঢ় হতে হলে জ্ঞান, বোধ ও সঠিক পরিকল্পনার পাশাপাশি ভাষার যথাযথ ব্যবহার জরুরি। তাই কথোপকথনে শিষ্টাচার ও অর্থবহ বার্তা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। উদ্দেশ্য যত মহৎ হবে, ভাষা ততই সুন্দর ও প্রভাববিস্তারী হবে।
সত্যভাষণ ও কথার সততা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—সবচেয়ে বড় খেয়ানত হলো, কাউকে এমন কথা বলা যা সে সত্য ভেবে নেয় অথচ তা মিথ্যা। তাই সর্বদা সত্যভাষণকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। কথার সাথে কাজের মিল না থাকলে সমাজে ভণ্ডামির পরিবেশ তৈরি হয়। আল্লাহ তাআলা কোরআনে সতর্ক করেছেন: “তোমরা মানুষকে ভালো কাজের নির্দেশ দাও অথচ নিজেরা তা ভুলে যাও!” (সূরা বাকারা: ৪৪)।
কোমলতা ও নম্রতা
কথার মধ্যে কোমলতা ও নম্রতা থাকা উচিত। আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের মতো জালেম শাসকের সাথেও হযরত মূসা (আ.)-কে নরম ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাহলে সাধারণ মানুষের সাথে আমাদের ভাষা কতটা কোমল ও শিষ্ট হওয়া উচিত—তা সহজেই অনুমেয়।
কথার শিষ্টাচার
শ্রোতার অবস্থা বিবেচনা: বয়স, মানসিক অবস্থা ও বুদ্ধি অনুযায়ী কথা বলা উচিত।
পিতামাতার সাথে আচরণ: কোরআনে নির্দেশ এসেছে—তাদের সামনে কখনো ‘উফ্’ শব্দও উচ্চারণ করো না।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ: রাগের বশে বা আবেগতাড়িত হয়ে কথা বললে সম্পর্ক নষ্ট হয়। তাই সংযম বজায় রাখা জরুরি।
অন্যের মতামত শোনা: কেবল নিজের জ্ঞানকে সঠিক মনে করে সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ থাকা উচিত নয়।
চোখে চোখ রেখে কথা বলা: এ অভ্যাস আন্তরিকতা ও সম্মানের পরিচয় দেয়।
কল্যাণকর বাক্য বলার উপকারিতা
হাদিসে এসেছে—একজন মানুষ অতি সাধারণ একটি ভালো কথা বলে ফেলেন, যাকে তিনি গুরুত্বও দেন না, অথচ আল্লাহ সেই কথার কারণে তাঁর মর্যাদা উঁচু করে দেন (সহিহ বুখারী)। তাই আমাদের উচিত কথার মধ্যে আশা, প্রেরণা ও কল্যাণের বার্তা রাখা।
উপসংহার
ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। সুন্দরভাবে কথা বলার মাধ্যমে যেমন সম্পর্ক মজবুত হয়, তেমনি সমাজে নৈতিকতার পরিবেশও তৈরি হয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত—ভাষাকে কোমল, সত্যনিষ্ঠ, কল্যাণকর ও শিষ্টাচারসমৃদ্ধ করা। এতে শুধু ব্যক্তিগত উন্নতিই হবে না, বরং গোটা সমাজও উপকৃত হবে।
আরও পড়ুন: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতে সাহাবির দাসত্বমুক্তির অনন্য কাহিনি | সালমান ফারসি (রা.)-এর জীবনী