বাংলাদেশের সাংবাদিক জগতে দীর্ঘ পথচলা করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। তবে তাঁর জীবনাবসান হয়েছিল এক গভীর বেদনাময় পরিস্থিতির মধ্যে। জীবনের শেষ প্রহরে লিখে যাওয়া একটি চিঠিতে তিনি রেখে গেছেন হতাশা, প্রশ্ন ও আক্ষেপের অগণিত কথা।
নিখোঁজ হওয়ার পর মেঘনায় লাশ উদ্ধার
বৃহস্পতিবার সকালে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। কিন্তু সেই দিনই তিনি আর ফিরে আসেননি। রাত অবধি বাসায় না ফেরায় পরিবার রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। পরের দিন শুক্রবার বিকেলে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার মেঘনা নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে গিয়ে তাঁর দেহ শনাক্ত করেন।
জীবনের শেষ লেখা: এক খোলা চিঠি
নিখোঁজ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে বিভুরঞ্জন সরকার ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে একটি লেখা পাঠিয়েছিলেন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে। সেই লেখায় তিনি স্পষ্ট করে লিখে গিয়েছিলেন, “এটা আমার জীবনের শেষ লেখা, চাইলে প্রকাশ করতে পারেন।”
চিঠির ভাষায় ফুটে উঠেছে জীবনের প্রতি তাঁর গভীর হতাশা ও অপ্রাপ্তির বেদনা। তিনি লিখেছিলেন—
“আমার জীবনে কোনো সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও কোথাও দৃঢ় অবস্থান নিতে পারিনি। ঘাটতি থেকেই গেছে। দুঃখই হয়তো আমার শেষ সঙ্গী হবে। আর পৃথিবীর সব প্রাণী সুখী হোক।”
পারিবারিক ও পেশাগত আক্ষেপ
লেখায় উঠে এসেছে ব্যক্তিগত জীবনের নানা সংকট। তিনি লিখেছিলেন ছেলের অসুস্থতা ও চাকরি না পাওয়া, মেয়ের ফলাফলে হতাশা এবং সংসারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কথা। পাশাপাশি সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রাপ্য মর্যাদা বা সম্মানী না পাওয়ার অভিযোগও করেছেন।
“নামে-বেনামে হাজার হাজার লেখা লিখেছি, অথচ সম্মানী পেয়েছি খুব সামান্য। অনেক পত্রিকা বছরের পর বছর লেখার পরও কোনো টাকা দেয়নি।”
রাজনৈতিক বাস্তবতা ও অভিযোগ
খোলা চিঠিতে তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও রয়্যালটি না পাওয়া, বিভিন্ন সাংবাদিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, এমনকি গণমাধ্যমে কাজ করার সময় নানান চাপের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
তাঁর লেখায় উল্লেখ ছিল—
“শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে থাকার কারণে আমাকে আওয়ামী ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে কোনো সুবিধা পাইনি।”
বর্তমান সরকারের অধীনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করেন। সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার সময় তাঁর লেখা প্রকাশে বাধার ঘটনাও উল্লেখ করেন তিনি।
দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবন
১৯৫৪ সালে জন্ম নেওয়া বিভুরঞ্জন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। প্রায় পাঁচ দশক ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। দৈনিক আজাদ, মাতৃভূমি, সাপ্তাহিক চলতিপত্র, একতা, মৃদুভাষণসহ একাধিক গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালন করেছেন। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ লিখে পাঠকপ্রিয়তা পান।
শেষ কথার মর্মস্পর্শী শিক্ষা
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের জীবন কাহিনী যেন বাংলাদেশি সাংবাদিকতার আর্থিক অনিশ্চয়তা, অপ্রাপ্তি ও চাপের প্রতিচ্ছবি। তাঁর শেষ চিঠি শুধু ব্যক্তিগত আক্ষেপ নয়, বরং দেশের গণমাধ্যমের বাস্তবতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তিনি জীবনের শেষে লিখে গিয়েছিলেন—
“আমার কোথাও না কোথাও ঘাটতি থেকে গেছে, আর সেই ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা হলো না।”
উপসংহার
সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি আমাদের সমাজ, গণমাধ্যম এবং পেশাজীবনের প্রতি এক গভীর প্রশ্নও রেখে গেল। তাঁর শেষ লেখা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—সাফল্য মানে শুধু পদোন্নতি, অর্থ বা প্রাপ্তি নয়; বরং সম্মান, মর্যাদা এবং নিরাপদ জীবনও একজন পেশাজীবীর বড় অর্জন হতে পারে।
আরও পড়ুন: টানা পাঁচ দিন ভারী বৃষ্টি: আবহাওয়া অফিসের সতর্কবার্তা