টাঙ্গাইলের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম)-এর টাঙ্গাইল শহরের বাসভবন ‘সোনার বাংলা’ গত শনিবার রাতের আঁধারে হামলার শিকার হয়। অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা হঠাৎ করেই তার বাড়িতে ভাঙচুর চালায়, যার ফলে এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
রাতের আঁধারে আকস্মিক হামলা
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার রাত প্রায় ১টার দিকে ১০ থেকে ১৫ জন মুখোশধারী দুর্বৃত্ত হঠাৎ করে কাদের সিদ্দিকীর বাড়িতে ইটপাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। পরে তারা মই বেয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এ সময় বাড়ির আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে হামলাকারীরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
বাসার কেয়ারটেকার গণমাধ্যমকে জানান, তখন কাদের সিদ্দিকী নিজ কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন। হামলার শব্দে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেও, পরে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।
পুলিশের তদন্ত শুরু
হামলার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যায় টাঙ্গাইল থানা পুলিশ। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভির আহমেদ জানান, ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে এবং হামলাকারীদের চিহ্নিত করে শিগগিরই আইনের আওতায় আনা হবে।
১৪৪ ধারা জারি ও থমথমে পরিস্থিতি
এদিকে, বাসাইল উপজেলা শহরে একই সময়ে দুটি আলাদা সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কাদের সিদ্দিকীর সমর্থকদের আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ও ছাত্র সমাজের ব্যানারে ঘোষিত ছাত্র সমাবেশ একই স্থানে হওয়ার কথা ছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শনিবার রাতেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আকলিমা বেগমের স্বাক্ষরিত আদেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
রবিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত এই ধারা কার্যকর ছিল। এ সময়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর ও আশপাশের ৫০০ গজ এলাকাজুড়ে সব ধরনের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শহরের প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসানো হয়। দোকানপাট বন্ধ থাকে এবং রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচলও ছিল সীমিত। থমথমে পরিবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
সমাবেশের অনুমতি নিয়ে দ্বন্দ্ব
সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আগেই সমাবেশ করার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। কোম্পানি কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন এবং জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুলিপি দেন।
পরে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকেও একই স্থানে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে আরেকটি আবেদন করা হয়। দুই পক্ষই আলাদা সমাবেশের ডাক দিয়ে মাইকিং শুরু করলে আইনশৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কায় প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেয়।
বাসাইল থানার ওসি জালাল উদ্দিন বলেন, “একই সময়ে একই স্থানে দুটি সমাবেশ ডাকায় সংঘাতের আশঙ্কা ছিল। তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।”
কাদের সিদ্দিকীর সংবাদ সম্মেলন
রবিবার দুপুরে নিজ বাসভবন *‘সোনার বাংলা’*য় এক সংবাদ সম্মেলনে কাদের সিদ্দিকী সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন,
“আমি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছি—এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ২৬ বছর আগে আমি নিজে থেকেই কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রতিষ্ঠা করেছি। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশের জনগণকে আমি সর্বদা সম্মান করি।”
তিনি আরও বলেন, যদি তার বাড়ি ভাঙচুরের মাধ্যমে দেশের শান্তি আসে তবে তিনি নিজেই বাড়ি ভাঙার আহ্বান জানাবেন। একই সঙ্গে তিনি হামলার ঘটনায় কাউকে সরাসরি দায়ী করেননি, তবে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, দেশের একমাত্র বেসামরিক বীর উত্তমের বাড়ি যখন নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকির মুখে—তা বোঝাই যাচ্ছে।
উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা
সংবাদ সম্মেলনে কাদের সিদ্দিকীর ছোট ভাই শামীম আল মনসুর আজাদ সিদ্দিকীসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন। তারা হামলার ঘটনার নিন্দা জানান এবং দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি তোলেন।
উপসংহার
কাদের সিদ্দিকীর বাসভবনে হামলার ঘটনায় টাঙ্গাইলজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বাসাইলে সমাবেশকে কেন্দ্র করে ১৪৪ ধারা জারি করায় শহরে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
আরও পড়ুন: গাজা অভিমুখে ৪৪ দেশের ১০০ জাহাজ: মানবতার সবচেয়ে বড় সমুদ্র মিশন