বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি আমাদের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত, আজ তাঁর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে। বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার গানে যিনি সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে, তিনি আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন।
বিদ্রোহী কবির অমর কণ্ঠ
কাজী নজরুল ইসলামকে বলা হয় “বিদ্রোহী কবি“। তাঁর কলম যেমন ছিল শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের হাতিয়ার, তেমনি প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতি ছিল অগাধ মমত্ববোধ। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’ — এই অমর পঙক্তিতেই ফুটে ওঠে তাঁর দ্বৈত সত্তা। আবার প্রেমের কবিতায় তিনি গেয়েছেন — ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল’। বিদ্রোহ ও প্রেমের এই অপূর্ব মিশেল তাঁকে করেছে অনন্য।
কবির শেষ প্রস্থান
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (বাংলা ১২ ভাদ্র ১৩৮৩) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চিকিৎসাধীন ছিলেন তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়)। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। এভাবেই তাঁর সেই বিখ্যাত গজল— “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোর থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই”— বাস্তবে রূপ নেয়।
তাঁর অবদান
নজরুল ছিলেন শুধু কবি নন, ছিলেন সংগীতকার, গীতিকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ। ১৯২২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই তাঁকে এনে দেয় অনন্য পরিচিতি। তিনি বাংলাকে উপহার দিয়েছেন নজরুলগীতি, গজল, কীর্তন, শ্যামাসংগীতসহ অসংখ্য কালজয়ী সৃষ্টি। সাম্যবাদ ও মানবতার জয়গানই ছিল তাঁর লেখার মূল দর্শন।
এ কারণে তাঁকে শুধু বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবেই নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি
জাতীয় কবির ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ রাজধানীসহ সারাদেশে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন সকালে কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবে।
বাংলা একাডেমি কবির জীবন ও কর্মের ওপর বিশেষ সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বিকেলে একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘নজরুলের মৌলচেতনা অদ্বৈতবাদী সমন্বয়ের’ ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল হক। আলোচনায় যোগ দেবেন অধ্যাপক ড. সৈয়দা মোতাহেরা বানু এবং কবি-প্রাবন্ধিক কাজী নাসির মামুন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
বিকেলের সাংস্কৃতিক আয়োজনে থাকছে আবৃত্তি ও নজরুলগীতি পরিবেশনা। অংশ নেবেন আবৃত্তিশিল্পী টিটো মুন্সী এবং সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌস আরা, শহীদ কবির পলাশ ও তানভীর আলম সজীব।
এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কবির মাজারে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাঁকে স্মরণ করছে গোটা জাতি।
নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা আজও
বর্তমান সময়ে সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্য, সাম্প্রদায়িকতা ও অবিচারের বিরুদ্ধে যে কণ্ঠস্বর প্রয়োজন, সেই কণ্ঠস্বর বহু বছর আগেই উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। তাঁর লেখা আজও আমাদের মানবিক চেতনা, সাম্যের আদর্শ এবং স্বাধীনতার প্রেরণা জোগায়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা কেবল শোকাহত হই না, বরং নতুন করে অনুপ্রাণিত হই তাঁর আদর্শে।
আরও পড়ুন: অতিদারিদ্র্যের বিস্তার ও সংকটে জনজীবন : একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন