মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম, প্রতারণা ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগে দেশের ১০০টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদেশগামী কর্মীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত খরচের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি টাকা নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এ ঘটনায় সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের করুণ অভিজ্ঞতা
ভুক্তভোগীদের একজন, রাব্বি হোসাইন, প্রায় দুই বছর আগে নুরুজ্জামান অ্যান্ড সন্স লিমিটেডের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাকে পাঠানো হয়নি। বরং পুরো অর্থ ফেরত না দিয়ে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়। একইভাবে শত শত যুবক বিদেশে কাজের স্বপ্ন পূরণের আশায় বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
সরকারি নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আদায়
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০২২ সালে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারণ করে ৭৮,৯৯০ টাকা। অথচ বাস্তবে অনেক এজেন্সি একজন কর্মীর কাছ থেকে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছে, যা আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি অর্থ নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
অনুসন্ধানে উঠে আসা নানা অপরাধ
সিআইডির এক বছরের দীর্ঘ তদন্তে শুধু অতিরিক্ত টাকা আদায় নয়, বরং মানবপাচার, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের মতো গুরুতর অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। প্রতিটি এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত ছিল একাধিক মধ্যস্বত্বভোগী, যারা বিভিন্ন ধাপে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। যদিও এজেন্সিগুলোর দাবি—তারা সরাসরি অতিরিক্ত অর্থ নেয়নি, বরং দালাল চক্রই এসব অর্থ আদায় করেছে।
কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি
সিআইডি ইতোমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন স্থগিত করেছে এবং একাধিক এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করার মতো তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। শিগগিরই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে পৃথক মামলা করে তদন্ত শুরু হবে। পাশাপাশি যেসব এজেন্সির বিরুদ্ধে মানবপাচার ও প্রতারণার মতো অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযুক্ত এজেন্সির তালিকা
তদন্তাধীন ১০০ এজেন্সির মধ্যে রয়েছে—মেরিট ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিঃ, দ্যা সুপার ইস্টার্ন লিমিটেড, মদিনা ওভারসিজ, কিউ কে কুইক এক্সপ্রেস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম, দাহমাশি কর্পোরেশন, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, সুলতান ওভারসিজ, গ্যালাক্সি কর্পোরেশন, আল ফারাহ হিউম্যান রিসোর্সেস, অপরাজিতা ওভারসিজ, আল খামিস ইন্টারন্যাশনালসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান।
বায়রার অবস্থান
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী জানিয়েছেন, অভিযুক্ত এজেন্সিগুলোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে সব ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। তার দাবি—মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত অর্থের বাইরে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়নি।
এ ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে, বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। সঠিক আইনি ব্যবস্থা ও কঠোর তদারকি ছাড়া এ ধরনের অনিয়ম রোধ করা কঠিন হবে। প্রবাসে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন পূরণের পথে যেন আর কেউ প্রতারণার শিকার না হয়, সে জন্য কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন: সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় চ্যালেঞ্জ এআই ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার: সিইসি