বাংলাদেশের সরকারি খাতে দুর্নীতির গল্প নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় উঠে এসেছে বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আইয়ুব আলী-এর নাম। তিনি কেবল একজন প্রকৌশলী নন, বরং কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। অভিযোগ রয়েছে, অনিয়ম, ভুয়া বিল, ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং নানা ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি গত এক দশকে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ।
আইয়ুব আলী বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত বিআইডব্লিউটিপি-১ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ সরকারি চাকরিজীবী হয়েও তার নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়ি, জমি, প্লট, গরুর খামার, মুরগির খামার, মাছের ঘের এমনকি বিদেশেও সম্পদ কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
নাম-বেনামে সম্পদের বিস্তার
২০১২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আইয়ুব আলী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল সম্পদ গড়ে উঠেছে।
ঢাকা শহর ও আশপাশে: বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ধানমণ্ডি, বারিধারা ডিওএইচএস, হাজারীবাগ, আফতাবনগর, পূর্বাচল, আশুলিয়া ও সাভারে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট।
বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, যশোরের বাঘারপাড়া, মাগুরার শালিখা, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, ভৈরব ও কালীগঞ্জে জমি ও খামার।
খামার ও প্রকল্প: আশুগঞ্জে ৫০ শতাংশ জমিতে গড়ে উঠছে বিশাল মুরগির খামার ও বায়োগ্যাস প্লান্ট। লক্ষ্য, অন্তত এক হাজার পরিবারকে গ্যাস সরবরাহ। পাশাপাশি রয়েছে মাছের ঘের ও গরুর খামার।
বিদেশে সম্পদ কেনার অভিযোগ
শুধু দেশে নয়, অভিযোগ রয়েছে লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে বাড়ি ক্রয় করেছেন আইয়ুব আলী। এছাড়া তার দুই ছেলের নামে অস্ট্রেলিয়াতেও সম্পদ রয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সরকারি চাকরিজীবীর বেতন দিয়ে এই বিপুল সম্পদ কেনা সম্ভব নয়—এমন প্রশ্ন এখন উঠছে সর্বত্র।
ঠিকাদারি ও ড্রেজিংয়ে অনিয়ম
বিআইডব্লিউটিএ’র প্রায় সব ড্রেজিং প্রকল্পেই আইয়ুব আলীর নাম ভেসে আসে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে—
প্রতি ঘনমিটার মাটি অপসারণে প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি টাকা বিল করা হয়।
কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ করে ৭০০ কোটি টাকার বিল লোপাট করা হয়েছে।
গত কয়েক বছরে নিম্নমানের ১১টি ড্রেজার আমদানির ক্ষেত্রেও ঘুষ নিয়ে বিল অনুমোদনের অভিযোগ রয়েছে।
এসব কারণে তিনি পরিচিত হয়েছেন ‘ড্রেজিং সাম্রাজ্যের রাজা’ হিসেবে।
প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার
আইয়ুব আলী তার রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি একাধিকবার ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করার ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে একদল ঠিকাদার তার ওপর হামলা চালায়, যার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
পরিবারের বিলাসবহুল জীবন
আইয়ুব আলীর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে সবাই নানা নামে জমি ও ফ্ল্যাটের মালিক।
স্ত্রী ফারজানা নাহিদের নামে বসুন্ধরা ও বারিধারায় ফ্ল্যাট।
ছেলে নাভিদ ফারহানের নামে মিরপুর ও পূর্বাচলে জমি ও ফ্ল্যাট।
মেয়ে পূর্ণতা ফারজানার নামেও জমি কেনা হয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা বিদেশে পড়াশোনা ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। ব্যক্তিগত গাড়িও রয়েছে একাধিক।
সাংবাদিকের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইয়ুব আলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি অবৈধ সম্পদের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের পরামর্শ দেন।
উপসংহার
“প্রকৌশলী হয়েও চোর: এক প্রকৌশলীর যত সম্পদ”—এই গল্প শুধু একজন আইয়ুব আলীর নয়, বরং আমাদের সমাজ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। সরকারি চাকরিজীবীরা যখন তাদের পদ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠেন, তখন সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়।
এই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে কঠোর তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে, আর রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যক্তির পকেটে চলে যাবে।
আরও পড়ুন: আবারও কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ : সীমান্তে টান টান পরিস্থিতি