রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসে আরও একটি কলঙ্কিত অধ্যায় যুক্ত হলো। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের নির্মম হত্যাকাণ্ড শুধু একটি খুনই নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত অপরাধ যা আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব এবং অর্থের লোভের জালে জড়িত। গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য—এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ছিলেন তারই দীর্ঘদিনের বন্ধু ও ব্যবসায়িক সহযোগী আক্তারুজ্জামান শাহীন।
হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্র
তদন্তে জানা গেছে, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে আক্তারুজ্জামান শাহীনের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল। শাহীন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়রের ভাই, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এমপি আনারের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। কিন্তু অর্থ বণ্টন নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
শাহীন হত্যার পরিকল্পনা করেন কলকাতায়। গত ৩০ এপ্রিল তিনি চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমান ও এক বান্ধবীকে নিয়ে কলকাতায় যান। সেখানে তার দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদের সঙ্গে মিলে হত্যার নীলনকশা তৈরি করা হয়। ১০ মে শাহীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন, কিন্তু আমান ও তার দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় খুন বাস্তবায়নের।
কীভাবে ঘটলো নৃশংস হত্যাকাণ্ড?
১২ মে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনাও কলকাতায় যান। ১৩ মে তাকে নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় আমান ও তার সহযোগীরা। সেখানে তারা তাকে চাপাতির মুখে জিম্মি করে এবং শাহীনের পাওনা টাকা দাবি করে। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে তারা বালিশ চাপা দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
এরপর লাশ গুম করার জন্য তারা এমপির দেহটি কেটে টুকরো টুকরো করে। দুটি বড় ট্রলিব্যাগে লাশের টুকরো ভরে তারা তা বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়। কলকাতার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, আমান ও তার সহযোগীরা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রক্তের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।
গ্রেফতার ও তদন্তের অগ্রগতি
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে আমানুল্লাহ আমানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। আমান স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে, শাহীন তাকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ৫ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।
তবে শাহীন নিজে এখন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি নেপাল ও দুবাই হয়ে নিউ ইয়র্কে পৌঁছান। তাকে ফেরানোর জন্য আইনি প্রক্রিয়া চলছে।
হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে স্বর্ণ চোরাচালান
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের বিরুদ্ধেও স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ ছিল। শাহীন ও আনারের মধ্যে এই অবৈধ ব্যবসার লভ্যাংশ নিয়ে বিরোধই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কে এই আমানুল্লাহ আমান?
আমানুল্লাহ আমান পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) নেতা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে। ১৯৯১ সালে যশোরে গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে তিনি কারাবরণ করেন। পরবর্তীতে ২০০০ সালে আরেকটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তাকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ শুরু করেন।
মামলা ও আইনি লড়াই
এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের মেয়ে ডরিন শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। একইসঙ্গে কলকাতায়ও আলাদা মামলা করা হচ্ছে। কলকাতা পুলিশ ইতিমধ্যে লাশের টুকরো বহনকারী এক গাড়িচালককে আটক করেছে।
উপসংহার
এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের ফল নয়, এটি আমাদের সমাজে ক্রমবর্ধমান নিষ্ঠুরতা ও আইনের শাসনের দুর্বলতার চিত্রও ফুটে তোলে। আশা করা যায়, দ্রুততার সঙ্গে সকল অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
আরও পড়ুন: চরমোনাই পীরের দরবারে এনসিপি নেতাদের মত বিনিময়
#আনোয়ারুল_আজিম_আনার #ঝিনাইদহ #হত্যাকাণ্ড #কলকাতা #আমানুল্লাহ_আমান #আক্তারুজ্জামান_শাহীন #গোয়েন্দা_তদন্ত