ইসলামের ইতিহাসে সাহাবায়ে কিরামের ত্যাগ ও সংগ্রামের অসংখ্য কাহিনি রয়েছে। তবে এর মধ্যে অন্যতম অনন্য দৃষ্টান্ত হলো হজরত সালমান ফারসি (রা.)-এর জীবন কাহিনি। তিনি সত্য অনুসন্ধান এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দাসত্ব থেকে মুক্তির গল্প আজও আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে।
শৈশব ও সত্যের অনুসন্ধান
সালমান ফারসি (রা.)-এর জন্ম হয় ইরানের ইস্পাহানের জায়্যুন অঞ্চলের এক ধনী অগ্নিপূজারি পরিবারে। তাঁর পিতা ছিলেন এলাকার নেতা, আর সালমান (রা.) ছিলেন সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। শৈশব থেকেই তাঁর হৃদয়ে সত্যের সন্ধান ও প্রকৃত ধর্মের অনুসন্ধান জেগে উঠেছিল। আর সেই আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে নিয়ে যায় দীর্ঘ এক যাত্রায়।
দাসত্বে পতিত হওয়া
সত্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি নানা ধর্মীয় ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেন। একসময় প্রতারণার শিকার হয়ে বনু কালব গোত্রের হাতে বন্দী হয়ে পড়েন এবং দাসে পরিণত হন। সেই কঠিন অবস্থায়ও তিনি আশাহত হননি। তাঁর অন্তরে সর্বশেষ নবীর আগমন ও সত্য ধর্মের প্রতীক্ষা জেগে ছিল। অবশেষে মদিনায় এসে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ পান এবং ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেন।
দাসত্বমুক্তির জন্য মহানবীর প্রচেষ্টা
ইসলাম গ্রহণের পরও সালমান (রা.) দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলেন। একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কষ্টের কথা শুনে ব্যথিত হলেন এবং তাঁকে দাসত্বমুক্তির জন্য পরামর্শ দিলেন। নবীজি (সা.) বললেন—
“তোমার মনিবের সঙ্গে মুকাতাবা (মুক্তিপণ চুক্তি) করো।”
চুক্তি অনুযায়ী, সালমান (রা.)-কে ৩০০ খেজুরগাছ রোপণ করতে হবে এবং ৪০ উকিয়া স্বর্ণ দিতে হবে। এ সংবাদ শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের আহ্বান করলেন, যেন তাঁরা সালমানকে সাহায্য করেন। সাহাবিরা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী চারা দিলেন। অবশেষে ৩০০ চারার ব্যবস্থা হলো।
নবীজির হাতে চারাগাছ রোপণ
চুক্তি পূরণের জন্য সালমান (রা.) গর্ত খুঁড়তেন আর মহানবী (সা.) নিজ হাতে খেজুরগাছের চারা রোপণ করতেন। বিস্ময়কর বিষয় হলো, সেই সব গাছের কোনোটি শুকিয়ে যায়নি। এভাবেই চুক্তির একাংশ পূর্ণ হয়।
এরপর থেকে রইল স্বর্ণের দেনা। কিছুদিন পর একজন ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর কাছে ডিমের মতো একটি স্বর্ণখণ্ড নিয়ে আসেন। নবীজি (সা.) তা সালমানের হাতে দিয়ে বললেন—
“এ দিয়েই তোমার মুক্তিপণ পরিশোধ করো।”
সালমান (রা.) প্রথমে সন্দেহ করলেও, আল্লাহর কৃপায় সেই স্বর্ণ যথেষ্ট পরিমাণে হয়ে দাঁড়ায় এবং তিনি মুক্তির শর্ত পূর্ণ করতে সক্ষম হন।
ইসলামের জন্য তাঁর অবদান
দাসত্বে থাকার কারণে সালমান (রা.) বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তবে দাসত্বমুক্তির পর তিনি খন্দকের যুদ্ধসহ পরবর্তী সব গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। খন্দকের যুদ্ধে তাঁর প্রস্তাবিত কৌশলই মুসলিম বাহিনীকে রক্ষা করেছিল।
ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও জীবনযাপন
মুক্তির পর তাঁর নিজের কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জন্য হজরত আবুদ দারদা (রা.)-এর সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। মহানবী (সা.) সবসময় তাঁর সাহাবিদের পুনর্বাসনে সচেষ্ট ছিলেন।
উপসংহার
হজরত সালমান ফারসি (রা.)-এর জীবনী আমাদের শেখায় যে সত্যের পথে অটল থাকতে হলে ত্যাগ ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। মহানবী (সা.) শুধু ধর্মীয় নেতা নন, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ মানবপ্রেমী, যিনি তাঁর সাহাবিদের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিতেন। তাঁর হাতে সালমান ফারসি (রা.)-এর দাসত্বমুক্তির এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে।
আরও পড়ুন: ক্ষমা ও বরকত লাভের মহিমান্বিত দোয়া: একটি পরিপূর্ণ ইবাদত