সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে ভারতের সরকার নৌবাহিনীর জাহাজে তুলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে ফেলে দিচ্ছে। অভিযোগ অনুযায়ী, দিল্লি থেকে আটক করে অন্তত ৪০ জন রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং বলেছে— ভারতের এই পদক্ষেপ রোহিঙ্গাদের জীবনকে ‘চরম ঝুঁকির মধ্যে’ ফেলে দিয়েছে।
আটক ও নির্বাসনের অভিযোগ
নুরুল আমিন নামের এক রোহিঙ্গা যুবক জানিয়েছেন, তার ভাই খাইরুল ও পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে দিল্লি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানতে পারেন তিনি। এর আগে, ৬ মে দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত কয়েক ডজন রোহিঙ্গাকে স্থানীয় থানায় ডেকে পাঠানো হয়। ছবি ও আঙুলের ছাপ নেওয়ার কথা বলে তাদের আটক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিছুদিন পর জানা যায়, আটক শরণার্থীদের বিমানে করে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজে তোলা হয়। তাদের হাতে প্লাস্টিকের বাঁধন, চোখ-মুখ ঢাকা কাপড় এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সমুদ্রে নামতে বাধ্য করা হয়। কয়েকজন শরণার্থী জানিয়েছেন, দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা জাহাজে থাকার সময় তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
একজন শরণার্থী জানান, “আমাদের বন্দির মতো করে হাত বেঁধে চোখ ঢেকে রাখা হয়েছিল। তারপর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হলো।”
অন্য এক রোহিঙ্গা ফয়াজ উল্লাহ ভিডিও কলে তার হাতে আঘাতের দাগ দেখিয়ে বলেন, তাকে মারধর করা হয়েছে এবং জোর করে প্রশ্ন করা হয়েছে কেন তিনি ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন।
৪০ জনের মধ্যে প্রায় ১৫ জন ছিলেন খ্রিস্টান রোহিঙ্গা। তাদের ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করা হয় এবং জোরালো অপমানজনক মন্তব্য করা হয়। এমনকি তাদের খতনা হয়েছে কি না, সেটি পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, বর্তমানে মিয়ানমারে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধে রোহিঙ্গারা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। যেসব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের অনেকেই দক্ষিণ-পশ্চিম মিয়ানমারে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে সেখানেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই।
একজন রোহিঙ্গা যুবক ভিডিও কলে জানান, “আমরা এখানে নিরাপদ নই। পুরো এলাকা যেন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো।”
জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক টমাস অ্যান্ড্রুজ জানিয়েছেন, তার হাতে ভারতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। এসব প্রমাণ ভারতের কর্মকর্তাদের কাছেও দেওয়া হয়েছে, তবে তারা কোনো জবাব দেয়নি। জাতিসংঘ বলছে, রোহিঙ্গারা ভারত আসেনি কোনো স্বার্থে, বরং মিয়ানমারের ভয়াবহ নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে।
ভারতে রোহিঙ্গাদের সংকট
ভারতে রোহিঙ্গাদের কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দেশটির সরকার তাদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা করে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ২৩ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে নিবন্ধিত হলেও বাস্তবে সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে। ফলে তারা সবসময় অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
আদালতে মামলা ও ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
ভারতের সুপ্রিম কোর্টে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও আদালত অভিযোগগুলোকে ‘অবাস্তব’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে শুনানি হবে। সিদ্ধান্ত হবে— রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, নাকি ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে নির্বাসিত হতে থাকবে।
এদিকে ভারতে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ আর ঘরে থাকতে সাহস পাচ্ছেন না। নুরুল আমিন বলেন, “আমাদের ভেতরে শুধু ভয় কাজ করছে। মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় আমাদেরও ধরে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হবে।”
উপসংহার
ভারতের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের এই অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে মিয়ানমারের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, অন্যদিকে ভারতের কঠোর নীতি— রোহিঙ্গারা এখন দ্বিগুণ সংকটে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ঘটনায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করলেও চূড়ান্ত সমাধান এখনও অনিশ্চিত। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনই সময়ের দাবি।
আরও পড়ুন: পাঞ্জাবে চার দশকের ভয়াবহ বন্যা: প্রাণহানি ও ফসল উৎপাদনে গভীর শঙ্কা