বাংলাদেশ ক্রিকেটে অনেক তরুণ খেলোয়াড়ের উত্থান যেমন চোখে পড়ে, তেমনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভূমিকায় মানিয়ে নেওয়ার গল্পও অনন্য। সেই তালিকায় এখন অন্যতম নাম সাইফ হাসান। ক্যারিয়ারের শুরুতে যিনি ছিলেন টেস্ট ওপেনার হিসেবে পরিচিত, আজ তিনি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছেন বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একজন গুরুত্বপূর্ণ অলরাউন্ডার হিসেবে।
বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে জাতীয় দলে যাত্রা
সাইফ হাসান বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই আলোচনায় আসেন। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্বগুণের পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফরম্যান্স তাঁকে এনে দেয় জাতীয় দলের টেস্ট ক্যাপ। ২০২০ সালে অভিষেক হয় তাঁর টেস্টে। পাঁচ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৬ ম্যাচে গড়ে ৪৬-এর বেশি রান করে নির্বাচকদের নজর কাড়েন তিনি। শুরুতেই ধারণা করা হচ্ছিল, দীর্ঘমেয়াদে টেস্টে বাংলাদেশের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠবেন সাইফ।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। জাতীয় দলে ওপেনার হিসেবে যে ছয়টি টেস্ট খেলেছেন, সেখান থেকে কোনো হাফ-সেঞ্চুরিও পাননি তিনি। স্বাভাবিকভাবেই টেস্ট ক্যারিয়ার দ্রুতই থেমে যায়, আর সাথে সাথে সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও নিজেকে প্রমাণের চাপ বাড়তে থাকে।
টি-টোয়েন্টির হতাশা আর নতুন করে গড়ে ওঠা
২০২১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ দিয়ে সংক্ষিপ্ত সংস্করণে অভিষেক হয় সাইফের। তবে প্রথম দুই ম্যাচেই তিনি ১ এবং শূন্য রানে আউট হন। ব্যাট হাতে ব্যর্থতা এবং বোলিংয়ে কোনো বিশেষ অবদান না রাখতে পারায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুরুতেই বাধার সম্মুখীন হন।
এরপর প্রায় দুই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে থাকলেও তিনি হাল ছাড়েননি। নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে শুরু করেন। শুধু ব্যাটিং নয়, বোলিংয়েও মনোযোগ দেন। অফ-স্পিন বোলিংকে আরও কার্যকর করার পাশাপাশি মাঠের চারদিকে শট খেলার ক্ষমতা বাড়ান।
এশিয়ান গেমস থেকে প্রত্যাবর্তনের গল্প
২০২৩ সালে এশিয়ান গেমসে আবারও জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামেন সাইফ। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি পেলেও ধারাবাহিকতার অভাব আবারও পিছিয়ে দেয় তাঁকে। তবে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে টপ-অর্ডারে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বোলিং করায় নির্বাচকদের নজরে আসতে থাকেন।
প্রধান নির্বাচকের ভাষায়, দলের প্রয়োজন এমন ক্রিকেটার, যারা একাধিক ভূমিকায় অবদান রাখতে পারবেন। এই ‘মাল্টিপল প্লেসে অ্যাড্রেস’ করার সক্ষমতার কারণেই নেদারল্যান্ডস সিরিজ এবং এশিয়া কাপে ডাক পান সাইফ হাসান।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে স্বপ্নময় রাত
দুই বছর পর জাতীয় দলে ফিরে আসার পর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে যেন নতুন রূপে হাজির হন তিনি। লিটন দাসের হাতে বল তুলে দেওয়ার পরই নিজের প্রথম ওভারে তুলে নেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস এবং নিদামানুরুর উইকেট। মাত্র ২ ওভারে ১৮ রান খরচায় ২ উইকেট তুলে নিয়ে প্রমাণ করেন তাঁর বোলিংয়ের কার্যকারিতা।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। ব্যাট হাতে নেমে ১৯ বলে অপরাজিত ৩৬ রান করে ম্যাচ শেষ করেন টানা দুই ছক্কা হাঁকিয়ে। শুধু জয়ই এনে দেননি, বরং জানিয়েছেন তিনি এখন আর আগের সেই ব্যর্থ ওপেনার নন—বরং একজন পরিপূর্ণ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার।
সামনে দীর্ঘ পথচলা
ম্যাচ শেষে সাইফ হাসানের কথাগুলোই প্রমাণ করে তাঁর পরিশ্রমের গল্প, “অনেক কঠোর পরিশ্রম ও প্রক্রিয়া ছিল ফিরে আসার পেছনে। সুযোগ পেয়েছি আজ, সর্বোচ্চটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি।”
এই চেষ্টা আর আত্মবিশ্বাস যদি ধরে রাখতে পারেন, তবে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে সাইফ হাসান হয়ে উঠতে পারেন অন্যতম ভরসার জায়গা। তাঁর এই উত্থান শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যও এক ইতিবাচক সংকেত।
উপসংহার
সাইফ হাসানের ক্যারিয়ার প্রমাণ করে, ক্রিকেটে একবার ব্যর্থ হলেও নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলা সম্ভব। টেস্টের ব্যর্থতা তাঁকে ভেঙে দেয়নি, বরং তৈরি করেছে আরও শক্তিশালী। এখন তিনি শুধু একজন ব্যাটার নন, বরং একজন ব্যাটার-বোলার—যিনি বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সামনে সময়ই বলে দেবে, তাঁর এই নতুন অধ্যায় কতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আরও পড়ুন: এশিয়া কাপের আগে বাংলাদেশি ব্যাটারদের র্যাঙ্কিংয়ে ধস