বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি খাতের বিপুল সংখ্যক কর্মজীবী এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়বে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ছে, কিন্তু বেসরকারি খাত কী পাবে?
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নতুন একটি পে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক অর্থসচিব ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জাকির আহমেদ খান। কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, দশ বছর পর এই বেতন কমিশন গঠিত হলো। গত কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। যদিও সরকার দাবি করছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তবুও বেতন-ভাতার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সমন্বয় এখনো পুরোপুরি হয়নি।
মূল্যস্ফীতি ও বেতন বৈষম্য: সাধারণ মানুষের কী অবস্থা?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৪৮%। যদিও এটি আগের মাসের তুলনায় কিছুটা কম, তবুও দৈনন্দিন পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রয়ে গেছে। বিশেষ করে চাল, তেল, ডিম, মাছ-মাংসের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ালে বেসরকারি কর্মীদের ওপর চাপ বাড়বে। কারণ, বাজারে পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে। ফলে বেসরকারি চাকরিজীবীরা আরও সংকটে পড়বেন।”
বেসরকারি খাতে বেতন বাড়েনি, চাকরি সংকটও বাড়ছে
বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি মানুষ চাকরির বাজারে নিয়োজিত। এর মধ্যে সাড়ে ৫ কোটি মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যাদের বেতন কাঠামো অসংগঠিত। করোনা পরবর্তী সময়ে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানই বেতন বৃদ্ধি করতে পারেনি।
অন্যদিকে, সরকারি চাকরিজীবীরা ২০১৫ সালের পে স্কেল অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন। নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হলে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এর আওতায় আসবেন। এছাড়াও এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও সামরিক-বেসামরিক কর্মীদের নিয়ে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ২২ লাখে।
বেতন বৃদ্ধির প্রভাব: বেসরকারি কর্মীদের জন্য হতাশা
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। কারণ, বেতন বৃদ্ধির ফলে বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। ফলে, যাদের বেতন বাড়ছে না, তাদের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে।
এমনিতেই বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, শিক্ষা ও দৈনন্দিন পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে। সরকারি চাকরিজীবীরা যদি বেশি বেতন পান, তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও কর্মীদের বেতন বাড়ানোর চাপ অনুভব করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অনেক কোম্পানিই আর্থিক সক্ষমতা দেখাবে না।
সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ
সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো—
-
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা
-
বেসরকারি খাতে বেতন কাঠামো শক্তিশালী করা
-
নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা
ড. ফাহমিদা খাতুনের মতে, “সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ভালো, কিন্তু একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের কর্মীদের কথাও ভাবতে হবে। অন্যথায় সামাজিক বৈষম্য আরও বাড়বে।”
উপসংহার: কী করা উচিত?
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের কর্মীদের জন্যও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। ন্যায্য বেতন কাঠামো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি—এই তিনটি বিষয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
অন্যথায়, শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ালে বেসরকারি কর্মীরা আরও পিছিয়ে পড়বেন, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আরও পড়ুন: মাইলস্টোন স্কুলে নিহত দুই শিক্ষক পাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা
আপনার কী মতামত? সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কাঠামো কীভাবে সমন্বয় করা যায়? কমেন্টে জানান।