প্রবাস জীবন: এক অদৃশ্য যুদ্ধের ইতিকথা
প্রবাস, একটি শব্দ যা অনেকের কাছে রঙিন স্বপ্নের প্রতিশব্দ। উন্নত জীবন, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আর পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ পাড়ি জমান অচেনা ভূমিতে। কিন্তু এই স্বপ্নপূরণের পথ কতটা বন্ধুর, কতটা কষ্টের, তা কেবল একজন প্রবাসীই জানেন। বাইরের ঝলমলে মোড়কের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অদৃশ্য যুদ্ধ, যা প্রতিনিয়ত লড়ে যান প্রবাসীরা।
প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা
প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো প্রিয়জন থেকে দূরে থাকা। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে একা থাকাটা এক দুর্বিষহ যন্ত্রণা। বিশেষ করে যখন পরিবারের কোনো সদস্য অসুস্থ হয় বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া সম্ভব হয় না, তখন প্রবাসীদের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। রাতের নির্জন প্রহরে যখন একাকীত্ব গ্রাস করে, তখন কেবল প্রিয়জনদের মুখগুলোই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভিডিও কলে কথা বলা বা ছবি দেখা একরকম সান্ত্বনা দিলেও, তাদের স্পর্শের অভাব, কাছে থাকার অভাব সবসময়ই অনুভব হয়।
ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা
নতুন দেশে গিয়ে প্রবাসীরা প্রথম যে সমস্যার সম্মুখীন হন, তা হলো ভাষা এবং সংস্কৃতির ভিন্নতা। অপরিচিত ভাষার কারণে দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রেও নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিজেদের ঐতিহ্য, উৎসব ছেড়ে ভিন্ন এক পরিবেশে জীবনযাপন করা সহজ নয়। অনেক সময় প্রবাসীরা ভুল বোঝাবুঝি বা বৈষম্যের শিকার হন, যা তাদের মানসিক চাপ আরও বাড়িয়ে তোলে।
কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূলতা
কর্মক্ষেত্রে প্রবাসীদের নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। স্বল্প বেতন, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং কখনও কখনও অমানবিক আচরণও সহ্য করতে হয় তাদের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কঠোর পরিশ্রম করে তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, অথচ নিজেদের জীবন কাটছে অনিশ্চয়তা আর বঞ্চনার মধ্য দিয়ে। অনেক সময় ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, প্রতিবাদ করার সুযোগও পান না ভিনদেশের মাটিতে। ছুটির দিনেও অনেক প্রবাসী ওভারটাইম করে বাড়তি কিছু উপার্জনের আশায়, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে।
নিঃসঙ্গতা ও মানসিক চাপ
প্রবাস জীবন একাকীত্বে ভরা। কর্মব্যস্ত দিন শেষে যখন সবাই নিজ নিজ পরিবারে ফিরে যায়, তখন প্রবাসীরা একাকী নিজেদের ঘরে ফেরে। এই নিঃসঙ্গতা থেকেই জন্ম নেয় এক চাপা বিষণ্ণতা। মানসিক চাপ, হতাশা এবং উদ্বেগ তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। অনেক সময়ই তারা নিজেদের কষ্টগুলো কারো সাথে ভাগ করে নিতে পারেন না, কারণ তারা চান না পরিবারকে চিন্তায় ফেলতে। এই চাপা কষ্টগুলো ধীরে ধীরে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উৎসবহীন জীবন
দেশের মাটিতে উৎসব মানেই যেখানে আত্মীয়-স্বজনের ভিড় আর আনন্দ-উল্লাস, প্রবাসে তা এক নিস্তব্ধ দিন। ঈদ, পূজা, নববর্ষের মতো উৎসবগুলোতে প্রবাসীরা আরও বেশি করে নিজেদের প্রিয়জনদের অভাব অনুভব করেন। উৎসবের দিনেও তাদের কাজ করতে হয়, কিংবা একাকী বসে দেশের স্মৃতি রোমন্থন করতে হয়। উৎসবের রঙে নিজেদের রাঙানোর সুযোগ তাদের হয় না।
ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা
এত কষ্ট, এত প্রতিকূলতার পরেও প্রবাসীরা হাল ছাড়েন না। তাদের চোখে থাকে একটাই স্বপ্ন – একদিন সব কষ্ট শেষ হবে, পরিবারকে নিয়ে সুখে দিন কাটানোর জন্য আবার দেশে ফিরতে পারবেন। এই স্বপ্নই তাদের প্রতিটি মুহূর্তে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। তারা জানে, তাদের এই আত্মত্যাগ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছে, তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে।
প্রবাসীদের এই অদৃশ্য যুদ্ধের গল্পগুলো আমাদের জানা উচিত। তাদের ত্যাগ, শ্রম আর কষ্টের প্রতি আমাদের সম্মান জানানো উচিত। তাদের স্বপ্নগুলো যেন সত্যি হয়, সেই দোয়া করা উচিত। প্রবাসীরা শুধু অর্থ উপার্জনের মেশিন নয়, তারা আমাদেরই ভাই, আমাদেরই বোন, আমাদেরই সন্তান। তাদের প্রতি একটু সহানুভূতি, একটু ভালোবাসা তাদের এই কঠিন যাত্রাকে কিছুটা হলেও সহজ করে তুলতে পারে।
আরও পড়ুন: ইরান থেকে পাকিস্তানে আশ্রয়: ২৮ বাংলাদেশির কষ্টার্জিত যাত্রা