নেপালে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা, ব্যাপক বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন ঘিরে তৈরি হওয়া ক্ষোভ অবশেষে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলিকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অভূতপূর্ব আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ‘নেপো কিডস’ নামের একটি গোষ্ঠী।
‘নেপো কিডস’ শব্দের উৎস ও অর্থ
‘নেপো কিডস’ মূলত Nepotism (স্বজনপ্রীতি) থেকে আসা একটি শব্দ। নেপালের ধনী ও ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের সন্তানদের এ নামে ডাকা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনৈতিক উপায়ে উপার্জিত অর্থ ব্যবহার করে তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে থাকে।
তাদের দামী গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, বিলাসবহুল পার্টি কিংবা অবকাশ যাপনের ছবি প্রায়শই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সাধারণ জনগণের সঙ্গে এই তীব্র বৈষম্য নেপালের তরুণদের ক্ষোভকে আরও উসকে দিয়েছে।
কেন ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্ম?
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে নেপালের ১৫-২৪ বছর বয়সী যুবকদের বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ২০.৮%। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন তরুণের মধ্যে একজন কর্মসংস্থান পাচ্ছেন না। চাকরির অভাবে অনেকেই বিদেশে গমন করছেন এবং দেশটির অর্থনীতির বড় অংশ রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে যখন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা অবাধ বিলাসিতায় জীবন কাটাচ্ছে, তখন সাধারণ তরুণেরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর হতাশায় পড়েছেন। এই বৈষম্যই তাদের আন্দোলনে নেমে আসার অন্যতম প্রধান কারণ।
সামাজিক মাধ্যম: আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার
নেপালের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় সামাজিক মাধ্যম বড় ভূমিকা রেখেছে। দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ মানুষ সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৮%। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এই হার অনেক বেশি।
২০২৫ সালের শুরুতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব এবং হোয়াটসঅ্যাপসহ ২৬টি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। কিন্তু এই সিদ্ধান্তই তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভকে চরমে পৌঁছে দেয়। হ্যাশট্যাগ #NepoKids দেশটির ট্রেন্ডিং তালিকার শীর্ষে উঠে আসে এবং আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া
নেপালি কংগ্রেসের নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এনপি সৌদ স্বীকার করেছেন, স্বজনপ্রীতি নেপালের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের সমস্যা। তবে এর সমাধান আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
অন্যদিকে, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রদীপ গাওয়ালি মনে করেন, যদি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানরা যোগ্য হয়, তবে শুধু বংশপরিচয়ের কারণে তাদের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। তবে অনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে না, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সহিংসতা ও সরকার পতন
সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধকরণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ অন্তত সাতটি শহরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে শুধুমাত্র একদিনেই ১৯ জন নিহত এবং চার শতাধিক মানুষ আহত হন।
অবশেষে সহিংসতার দায় এড়াতে না পেরে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। নেপালের সচিবালয় থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
উপসংহার
নেপালের এই পরিস্থিতি শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং একটি সামাজিক বার্তাও বহন করছে। তরুণ প্রজন্ম আর অবিচার, বেকারত্ব এবং বৈষম্য মেনে নিতে রাজি নয়। ‘নেপো কিডস’ ইস্যু কেবল একটি প্রতীক—এর মাধ্যমে তারা দেখিয়ে দিয়েছে, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি সমাজকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
যদি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকর সংস্কার না আনে, তবে এ ধরনের আন্দোলন ভবিষ্যতেও দেখা দিতে পারে। নেপালের তরুণ প্রজন্মের এই ক্ষোভ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জন্যও একটি সতর্কবার্তা।
আরও পড়ুন: কুমিল্লায় ভাড়া বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ও তাঁর মায়ের মরদেহ উদ্ধার