লিভার (যকৃত) হলো মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা পেটের ডান পাশে অবস্থিত এবং এটি আমাদের শরীরের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ অঙ্গ। লিভারের কাজ অনেক বিস্তৃত; এটি খাদ্য হজম এবং রক্ত পরিস্রাবণ থেকে শুরু করে দূষিত পদার্থ নির্মূল, শক্তি সঞ্চয় এবং শরীরের বিভিন্ন প্রোটিন তৈরি পর্যন্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লিভার হজমে সাহায্য করার জন্য পিত্তরস (bile) তৈরি করে, যা শরীরের ফ্যাট ভেঙে হজমে সহায়তা করে। এছাড়া লিভার অতিরিক্ত গ্লুকোজ গ্লাইকোজেন হিসেবে সঞ্চয় করে, রক্তে টক্সিন ও ওষুধের ক্ষতিকারক প্রভাব নির্মূল করে, এবং রক্ত জমাট বাঁধাতে সহায়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন তৈরি করে।
লিভার কিভাবে কাজ করে
লিভার দুইটি প্রধান রক্ত নালী দ্বারা রক্ত সরবরাহ পায়—একটি হেপাটিক পোর্টাল শিরা, যা অন্ত্র থেকে খাদ্য থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি সমৃদ্ধ রক্ত নিয়ে আসে, এবং আরেকটি হেপাটিক আর্টারি, যা অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে। লিভারের কোষ গুলো এই রক্ত থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে বিপাকীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং পিত্তরস তৈরি করে। লিভার কোষ যেমন হেপাটোসাইট বিভিন্ন বিষ ও টক্সিন ভেঙে নিষ্ক্রিয় করার জন্য কাজ করে। ৫০০টিরও বেশি ফাংশন সম্পন্ন করার জন্য লিভার শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
লিভারে রোগ হওয়ার কারণ
লিভারে বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে, যার প্রধান কারণগুলো হলো:
-
অ্যালকোহল অপব্যবহার: বেশি মাত্রায় মদ্যপান লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সিরোসিস বা লিভার ফেইলিউরের কারণ হতে পারে।
-
হেপাটাইটিস ভাইরাস: বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি, সি ভাইরাস সংক্রমণ লিভারের প্রদাহ ও ক্ষতি করে।
-
মোটাতাজাকরণ: স্থূলতা বা অকেজো জীবনযাপন লিভারে ফ্যাটি জমা বাড়িয়ে রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
-
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ফাস্ট ফুড, প্রচুর চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার লিভারের ক্ষতির কারণ।
-
অটোইমিউন রোগ: শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজের লিভার কোষ আক্রমণ করলে ক্ষতি হয়।
-
বেশি ওষুধ ও টক্সিন গ্রহণ: কিছু ওষুধ ও পরিবেশগত বিষাক্ত পদার্থ লিভারের ক্ষতি করতে পারে।
লিভারে রোগ হলে চিকিৎসা প্রক্রিয়া ও খরচ
লিভার রোগের চিকিৎসা রোগের ধাপ ও ধরনের উপর নির্ভর করে:
-
প্রাথমিক পর্যায়ে: সাধারণত জীবনযাত্রার পরিবর্তন, খাদ্য ও ওষুধের সাহায্যে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
-
মাঝারি পর্যায়ে: ভাইরাস নির্বাশন, প্রদাহ কমানোর ওষুধ, ফ্যাটি লিভার রোগের ক্ষেত্রে ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং বিশেষ ডায়েট অনুসরণ করতে হয়।
-
চরম বা শেষ পর্যায়ে: লিভার কাজ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বা সিরোসিস, লিভার ফেইলিউরের ক্ষেত্রে লিভার প্রতিস্থাপন (লিভার ট্রান্সপ্লান্ট) করা হয়।
চিকিৎসার খরচ রোগের অবস্থান, হাসপাতাল ভেদে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত প্রাথমিক চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ কম হলেও, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট একাধিক লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। উন্নতমানের হাসপাতাল ও ডাক্তারের খরচ, ওষুধ ও পরবর্তী যত্নের জন্য আলাদা খরচ যুক্ত হয়।
লিভার প্রতিস্থাপন করা যায় কিনা?
হ্যাঁ, লিভার প্রতিস্থাপন বা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সম্ভব। এটি শেষ পর্যায়ের লিভার রোগের জন্য করা হয়, যখন লিভার আর তার কাজ চালিয়ে যেতে অক্ষম হয়ে পড়ে বা ব্যর্থ হয়। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত লিভার সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং একটি সুস্থ দাতার লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সফল হলে রোগীর জীবনমান অনেকটা উন্নত হয়, তবে এটি খুবই ব্যয়বহুল এবং জটিল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি।
লিভার ভালো রাখার উপায়
লিভারের সুস্থতা রক্ষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়:
-
সঠিক ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ: প্রোটিন, সবুজ শাকসবজি, ফলমূল এবং ফ্যাটি ওমেগা-৩যুক্ত মাছ খাওয়া উচিত। প্রক্রিয়াজাত ও চিনি ঝরা খাবার এড়িয়ে চলা ভালো।
-
মদ্যপান এড়িয়ে চলা: বিশেষ করে যারা লিভার রোগে ঝুঁকিপূর্ণ, তাদের মদ না খাওয়া সবচেয়ে জরুরি।
-
নিয়মিত ব্যায়াম: স্থূলতা রোধে এবং লিভারের ফ্যাটি জমা কমাতে সহায়তা করে।
-
পর্যাপ্ত পানি পান: শরীর থেকে টক্সিন নির্গমনে সাহায্য করে।
-
ভাইরাস থেকে সুরক্ষা: হেপাটাইটিস বি ও সি থেকে রক্ষা পেতে টিকা ও সুরক্ষা পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।
-
অতিরিক্ত ওষুধ ও টক্সিন গ্রহণ এড়িয়ে চলা: প্রয়োজন ছাড়া ওষুধ বেশি খাওয়া উচিত নয়।
-
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা: লিভার ফাংশন টেস্ট করে আগে থেকেই সমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব।
আরও পড়ুন: থাইরয়েড ক্যানসারের ওষুধ সংকট: রোগীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ