বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরে একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা প্রায় তিন বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনের বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষ দেখছেন—চাল, ডাল, তেল, ময়দা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত কমছে এবং আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে শুধু দরিদ্র পরিবার নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন বা ধার-দেনার ওপর নির্ভর করছেন। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গরিব পরিবারগুলো নিজেদের আয়ের চেয়ে বেশি খরচ করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
মূল্যস্ফীতির সাম্প্রতিক চিত্র
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৮.৫৫ শতাংশ, যেখানে জুন মাসে ছিল ৮.৪৮ শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা এখনো কার্যকর হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে দারিদ্র্যের হার আরও বাড়বে।
দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন বছরে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭.৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর চেয়েও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ২০২২ সালে যেখানে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ৫.৬ শতাংশ, সেখানে ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে।
কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, দারিদ্র্য বৃদ্ধির মূল কারণগুলো হলো—
আয়ের স্তর স্থবির হয়ে যাওয়া বা হ্রাস পাওয়া
শ্রমবাজারে দুর্বল অবস্থা
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মন্থর গতি
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নীতিগত দুর্বলতা
বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলমান খাদ্যমূল্যের চাপের কারণে ২০২৫ সালে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ অতিদারিদ্র্যের কাতারে চলে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রকৃত সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছানো জরুরি।
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)-এর মাধ্যমে সরকারি সহায়তা বিতরণ করলে দুর্নীতি কমবে।
দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে।
বৈষম্য কমাতে কর আদায় জোরদার করা দরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে।
জীবনের খরচ বেড়েছে বহুগুণ
খাদ্য ছাড়াও চিকিৎসা, বাসাভাড়া ও শিক্ষার খরচ বিগত কয়েক বছরে বহুগুণ বেড়েছে। ফলে মানুষের প্রকৃত মজুরি একই হারে না বাড়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। পিপিআরসি ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, অনেক পরিবারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য ঋণ নিতে হচ্ছে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনা মহামারী, ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা একসঙ্গে মিলে এই সংকটকে তীব্রতর করেছে। সর্বশেষ রাজনৈতিক অস্থিরতাও মানুষের আস্থা ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সামনে করণীয়
অধ্যাপক আবু আহমেদসহ অনেক অর্থনীতিবিদ আশা প্রকাশ করেছেন, স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকার আসলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি হবে, যা দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়ক হবে। পাশাপাশি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি উভয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপসংহার
অতিদারিদ্র্যের ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশের জন্য এক বড় সতর্ক সংকেত। যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আগামীতে আরও বড় সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং ন্যায়সঙ্গত নীতি প্রণয়ন ছাড়া এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ লেখা: প্রশ্ন, আক্ষেপ ও বিদায়ের গল্প